সরকারের হাতেই শিশুপুত্রকে তুলে দিল ধর্ষিত কিশোরী

বিচ্ছেদ: শিশুকে নিয়ে ওই কিশোরী (ডান দিকে)।

তিন মাসের ফুটফুটে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী৷ হাতে একটি কাগজ নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে কিশোরীর মা৷

মঙ্গলবার রাতে সেই কাগজটা পড়ে অবাক হয়ে যান আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের কর্তারা৷ সবটা জেনে কারও কারও মনে প্রশ্ন ওঠে, পনেরো বছরের মেয়ের সঙ্গে কেউ এমনটা করতে পারে? সেই বিস্ময় ছাপিয়ে ওঠে আর একটি বিস্ময়। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই কতটা শক্ত হয়ে উঠেছে কিশোরী মায়ের মন! মাত্র তিন মাসের ছেলেকে সে তুলে দিতে চায় সরকারের হাতে। শত যন্ত্রণার মধ্যেও সে সন্তানের জন্ম দিয়েছে। তাকে সিডব্লিউসি-র হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেও তার হাত কাঁপেনি।

তাই সরকারি খাতায় 'অনাথ'-এর তালিকায় উঠে এল ওই কুমারী মায়ের তিন মাসের সন্তানটি৷ মঙ্গলবার রাত থেকেই শিশুটির নতুন ঠিকানা হয়ে গেল হাসপাতালে চার দেওয়ালে ঘেরা একটি ঘর৷ হাসপাতালের সুপার চিন্ময় বর্মন বলেন, "শিশুটি ভাল রয়েছে৷ চিকিৎসকরা তাকে দেখছেন৷" সিডব্লিউসি-র চেয়ারম্যান কান্তি মোহান্ত বলেন, কিশোরী ও তার পরিবার সাত দিন সময় পাবে৷ তার মধ্যে শিশুটিকে নিয়ে না গেলে শিশুর প্রতি তাদের আর দাবি থাকবে না৷

ওই কিশোরী বুক বেঁধে সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছে। পাশে পেয়েছে তার মাকে। শিশুটিকে হাসপাতালে রেখে সে দিন রাতে আলিপুরদুয়ারেই ছিলেন দু'জনে। বুধবার দুপুরে কালচিনি ফিরে যাওয়ার আগে কিশোরী বলে, ''আর পিছনে তাকাতে চাই না৷ এ বার পড়াশোনা করতে চাই৷'' কিশোরীর মা-ও বলেন, ''যত কষ্টই হোক, মেয়েকে পড়াব৷'' কান্তিবাবুও জানান, ওই কিশোরী পড়াশোনা করলে তার স্টাইপেন্ডের ব্যবস্থা হবে৷

ওই কিশোরীর মা বলেন, ''আমি চাই মেয়ে আবার জীবন শুরু করুক নতুন করে। ওই একরত্তি সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে মেয়ের কী কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝি। কিন্তু এ ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই।'' 
কালচিনির একটি চা বাগান এলাকায় বাস কিশোরীর৷ মা-বাবা, এক বোন ও এক ভাই-ও রয়েছে৷ স্থানীয় একটি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে পড়াশোনা করত সে৷ কিন্তু অভিযোগ, কিশোরীর বাবা সময়ই মদ্যপ অবস্থায় থাকতেন৷ কোন কাজকর্মও করতেন না৷ ফলে সংসারের হাল ধরতে হয় মাকে৷ কিন্তু এলাকায় নিয়মিত কাজ না পেয়ে বছর দেড়েক আগে সন্তানদের বাড়িতে রেখেই দিল্লি পাড়ি দেন তিনি৷ অভিযোগ, সেই সময় থেকেই কিশোরীর উপর শুরু হয় যৌন নির্যাতন৷ তার এক নিকটাত্মীয় তাকে লাগাতার ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ৷ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে সে৷ গোটা ঘটনাটি জানতে পারেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা৷ সেই সংগঠনের অন্যতম কর্তা প্রসেনজিৎ রায় বলেন, "অনেক চেষ্টায় দিল্লিতে কিশোরীর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়৷ তাকে আমরা ফিরিয়ে আনি৷" কিশোরীর মা ফিরে এসেই ধর্ষকের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন৷ অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করে পুলিশ৷

কিন্তু প্রতিবেশীদের মুখ তো বন্ধ করতে পারেননি। কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে মাস তিনেক আগে পুত্র সন্তানটির জন্মও দেয় ওই কিশোরী৷ তার মা বলেন, ''পাড়ার লোকের গঞ্জনায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম। বাবার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও রেহাই পাচ্ছিলাম না।'' তখনই মা-মেয়ে সিদ্ধান্ত নেন, নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে।

কষ্ট হচ্ছে না? ওই কিশোরীর জবাব, ''কী খাওয়াতাম ছেলেকে? এখন পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।'' হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একবারও পিছন ফিরে তাকায়নি সে। চিবুক ছিল শক্ত।