‘আমরা ব্লাডি ইন্ডিয়ানস, চাকরি দেওয়ার ছলে বানাত ক্রীতদাস’


রবিবার সন্ধে থেকে ফোনে দফায় দফায় হুমকি ও পাল্টা হুমকি চলে কলকাতা ও মালয়েশিয়ার মধ্যে। একদিকে ন্যাশনাল অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং কমিটির (এনএটিসি) ন্যাশনাল চেয়ারম্যান শেখ জিন্নার আলি, অন্য দিকে একঝাঁক বাঙালি তরুণকে মধ্যযুগীয় দাসদের মতো ব্যবহার করা এক চিনা ব্যবসায়ী। শেেষ স্নায়ুর যুদ্ধে পরাজিত চিনা প্রৌঢ় পান্ডুয়ার সঞ্জয় মল্লিককে পৌঁছে দিতে বাধ্য হন বিমানবন্দরে। দমদমে নামার কিছু পরেই সঞ্জয় 'এই সময়'-কে শোনালেন আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের খপ্পরে পড়ার কাহিনি 


কর্মী নই, ক্রীতদাস
বনগাঁর কাছের 'রোহন ইন্টারন্যাশনাল' নামে সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম যখন, তখন শুনেছিলাম মালয়েশিয়ার স্কাইমাস্টার নামের সংস্থার কাজ করতে পাঠানো হচ্ছে আমাদের। গিয়ে দেখলাম, ওই সংস্থার অফিস কুয়ালালামপুরে। আমাদের কাজ করানো হল কুচিং নামের একটা শহরে। কিছুদিন পর গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। কলকাতা থেকে আমাদের মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার ব্যবসায়ীদের বিক্রি করে দিয়েছে রোহান ইন্টারন্যাশনালের মালিক কবির হোসেন মণ্ডল। যে কিনেছে আমাদের, সে আর এক জনকে বেচে দিল। এই মালিক নিজের মতো কাজ করাবে। পছন্দ না হলে এ আবার বেচে দেবে অন্য কারও কাছে। এ ভাবেই চলতে থাকবে।


নাম নয়, শুধুই নম্বর 
ওখানে আমার মতো যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কোনও নাম নেই। প্রথম দিন সবাইকে এক একটা হেলমেট আর সেফটি জ্যাকেট দেওয়া হল। তাতে যে নম্বর লেখা রয়েছে সেটাই আমার পরিচয়। আমি ৬০ নম্বরের হেলমেট আর জ্যাকেট পেয়েছিলাম। সেই থেকে ওখানে আমাকে 'নাম্বার-সিক্সটি' বা শুধুই 'সিক্সটি' বলে ডাকা হত। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা খাটাত ওরা। ৩৬টা লোহার রড, প্রতিটার ওজন ৭০ কিলোগ্রাম করে। এক ঘণ্টার মধ্যে তুলতে হবে নির্মীয়মাণ বহুতলে। কাজ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম এটা অসম্ভব। দাঁড়াতে পারছিলাম না। হঠাৎ পিঠে এসে পড়ল হেলমেটের বাড়ি। ঘুরে দাঁড়াতেই লাথি। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে ওভারশিয়ার বলে উঠল, 'ব্লাডি ইন্ডিয়ানস'। 


বেচাল দেখলেই ... 
একদিন থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, 'ফিরে যেতে চাই।' এর পর থেকেই ওদের আচরণ বদলে গেল। যে ঘরে আমাদের বন্ধ করে রাখা হত, সেই ঘরের জানলা দিয়ে কিংবা আসতে যেতে আমাদের 'পাহারাদাররা' বিশেষ ইঙ্গিত করতে শুরু করল। গলার আড়াআড়ি হাত চালিয়ে নলি কেটে দেওয়ার ইঙ্গিত। 


চিকিৎসা নেই, শয্যাশায়ী বহু 
বহুতলে কাজ করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল বনগাঁর জুলফিকর। ক্রমাগত পাথর ভাঙা ড্রিল মেশিন চালিয়ে অসহ্য কোমরের যন্ত্রণায় ভুগছে বলাগড়ের অমিত বিশ্বাস। আমারও সারা গায়ে র‌্যাশ। তবে আমাদের চিকিৎসা করিয়ে 'অনর্থক' খরচ করতে চায় না ওরা। 


বেচে দিত ইন্দোনেশিয়ায় 
একদিন গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হল এক জায়গায়। যেখানে থাকতাম সেখান থেকে অনেকটা দূর। দেখলাম সমুদ্রের ধারে একটা ছোট শহরে এসেছি। কিছুটা দূরে একটা দ্বীপ। জঙ্গলে ঢাকা। বলা হল, ওই দ্বীপটা ইন্দোনেশিয়ার অংশ। শুনলাম, আমাকে ইন্দোনেশিয়ার এক কন্ট্রাক্টরের কাছে বেচে দেওয়ার কথা হচ্ছে। স্থানীয় একজন বলল, ঘোর জঙ্গলে কেবল লাইন পাতার কাজ। বুঝলাম, একবার মালয়েশিয়া থেকে বেরোলে আর দেশে ফিরতে হবে না। তখনই একজন ন্যাশনাল অ্যান্টি-ট্র্যাফিকিং কমিটির কথা বলল। ভিডিয়ো ক্লিপিংসে নিজেদের দশার কথা জানালাম এনএটিসি-কে। 


ওই দু'ঘণ্টা জীবনে ভুলব না 
এনএটিসি-কে আমাদের অবস্থার কথা জানিয়ে যে ভিডিয়ো পাঠিয়েছিলাম, সেটা যে কলকাতার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে সেটা জানতাম না। কিন্তু, এনএটিসি-র সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। রবিবার সন্ধেয় হঠাৎ আমাদের ঘরে ঢুকল আমাদের কন্ট্রাক্টর। সংবাদমাধমে কেন খবর বেরিয়ে তা জানতে চেয়ে মারধর শুরু করল। সেই সময় আমিও কলকাতায় এনএটিসি-র চেয়ারম্যান শেখ জিন্নার আলিকে ফোন করলাম। ওদের মতলব ছিল আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু, অন্য দিকে জিন্নার আলি ক্রমাগত ওই চিনা কন্ট্রাক্টরকে হুমকি দিচ্ছিলেন আমাকে বিমানবন্দরে বা ভারতীয় দূতাবাসে পৌঁছে না দিলে ভারত সরকার ময়দানে নামবে। 


রোহন ইন্টারন্যাশনালের বক্তব্য
কর্মী বাবু মণ্ডল বলেন, 'আমরা বাইরে পাঠানোর সময় জানিয়ে দিই, তিন বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ফিরতে গেলে জরিমানা-বাবদ কিছু অর্থ দিয়ে ফিরতে হবে। অনেকেই তা-ই করেন। কোনও কন্ট্রাক্টর মারধর করেছেন কি না, সেটা আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। আগে কেউ এমন অভিযোগ করেননি।' 


এনএটিসি যা বলছে 
সংস্থার ন্যাশনাল চেয়ারম্যান শেখ জিন্নার আলি বলেছেন, 'মালয়েশিয়ার যে র৵াকেটের কথা আমরা জেনেছি, ওই র৵াকেটের মাথা সিম নামে এক চিনা ব্যবসায়ী। সে ফ্রান্সিস ও মাইকেল নামে দুই সহযোগীর সঙ্গে ভারতীয় শ্রমিক কিনে নিজের কাজে লাগায়। অন্য কোনও ব্যবসায়ীর কাছে বেচেও দেয়। আমরা এখনও পর্যন্ত জেনেছি, সঞ্জয়কে অন্তত ১০ লক্ষ টাকায় বেচে দেওয়া হচ্ছিল ইন্দোনেশিয়ায়।'