জন্ম নিয়ন্ত্রণে শীর্ষে থেকেও নাবালিকা মা বাড়ছে রাজ্যে


শাঁখের করাতে রাজ্যের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি! একদিকে দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে সেরার শিরোপা দখলে। অন্য দিকে আবার কৈশোরে সন্তানধারণ করার নজিরে (টিন-এজ প্রেগন্যান্সি) ত্রিপুরাকে বাদ দিলে সবচেয়ে খারাপ 'পারফরম্যান্স' পশ্চিমবঙ্গেরই। বৈপরীত্যে ঘেরা এই পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে উভয়সঙ্কটের মুখোমুখি রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। কেননা, জন্ম নিয়ন্ত্রণের ফাঁস আলগা করার তাগিদ তৈরি হয়েছে রাজ্যে। 

অথচ সে পদক্ষেপেও সিঁদুরে মেঘ দেখছেন স্বাস্থ্যকর্তারা--- যদি আরও বেড়ে যায় টিন-এজ প্রেগন্যান্সির হার! কী ভাবে তৈরি হল এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি? স্বাস্থ্যভবনের কর্তারা জানাচ্ছেন, 'হম দো হমারা দো'র রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সারা দেশ জনবিস্ফোরণ রুখতে মরিয়া গত কয়েক দশক ধরে। লক্ষ্য, দেশের প্রজননক্ষম দম্পতিদের মধ্যে সন্তানধারণের হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) ২-এ নামিয়ে আনা। দেশে দম্পতি পিছু সন্তানের সংখ্যা যখন গড়ে ৪-৫ ছিল, তখন থেকেই এ নীতির সূত্রপাত৷ কিন্তু তিন দশকের পরই দেখা যায়, গোটা দেশের তুলনায় এ ব্যাপারে বাংলার উন্নতির লেখচিত্র অনেকটাই এগিয়ে। 

এবং ২০১০-এই দেখা যায়, কেন্দ্রীয় লক্ষ্যমাত্রা চেয়েও নেমে গিয়েছে বাংলার টিএফআর (১.৮)। গত ক'বছরে তা আরও নেমে গিয়ে ১.৬-এ ঠেকেছে যা দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। তারই স্বীকৃতি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সম্প্রতি পরিবার পরিকল্পনায় সেরার পুরস্কার পেয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কাছ থেকে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জগৎপ্রকাশ নাড্ডা গুয়াহাটিতে সে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর হাতে।কিন্তু সেখানেই আবার জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় পরিবার পরিকল্পনা সমীক্ষার চতুর্থ সংস্করণের রিপোর্ট বলছে, জন্ম নিয়ন্ত্রণে বাংলার পারফরম্যান্স শ্রেষ্ঠ হলেও, টিন-এজ প্রেগন্যান্সিতে রাজ্যের অবস্থান একেবারে নিকৃষ্টতম দু'টি রাজ্যের মধ্যে। দিল্লি, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে যেখানে টিন-এজ প্রেগন্যান্সির হার ২-৩%, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে সেই হার ১৮%। যার অর্থ, প্রতি ১০০ জন মায়ের মধ্যে বাংলায় অন্তত ১৮ জনই সন্তানধারণ করেছেন ১৫-১৯ বছর বয়সের মধ্যে।সঙ্কটের কথা মানছেন স্বাস্থ্য দপ্তরের আমলা-আধিকারিকরাও। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, 'পরিবার পরিকল্পনায় সেরার শিরোপা পাওয়ার কৃতিত্ব এ রাজ্যের আশা কর্মী, এএনএম নার্স এবং চিকিৎসকদের। কিন্তু উল্টো দিকে, টিন-এজ প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা এখন বড় মাথাব্যথা। সেটাকে কমানো জরুরি। পাশাপাশি দেখা প্রয়োজন, টিএফআর যেন আরও নেমে না-যায়।' রাজ্যের পরিবার কল্যাণ আধিকারিক অসীম দাস মালাকার বলেন, 'টিন-এজ প্রেগন্যান্সির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে প্রসূতি ও শিশুর স্বাস্থ্যে। পরিণত বয়সের আগে সন্তানধারণের জন্য প্রসূতির নিজের স্বাস্থ্যের পাশাপাশি বিঘ্নিত হয় নবজাতকের স্বাস্থ্যও। ফলে প্রসূতিমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বেগ পেতে হয় সরকারকে।' তাঁর মূল্যায়ন, টিন-এজ প্রেগন্যান্সির সমস্যাটি আদতে আর্থ-সামাজিক সমস্যা। অথচ তার কুপ্রভাবটি সরাসরি পড়ে স্বাস্থ্যের উপর।

স্বাস্থ্য ভবনের এক পদস্থ কর্তার মতে, দুটো বিপরীত সূচককে একসঙ্গে সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন। তিনি বলেন, 'টিএফআরের ব্যাপারে স্থিতাবস্থায় জোর দেওয়াই প্রধান লক্ষ্য। কেননা, পরিবার পরিকল্পনায় আমরা এতটাই এগিয়ে গিয়েছি যে জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জাতীয় গড়ের সঙ্গে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়ে গিয়েছে রাজ্যের৷ তাই রাজ্যজুড়ে আর জন্ম নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি বাড়ানো হবে না। বরং ফি বছর ধীরে ধীরে কমিয়ে দেওয়া হবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে দম্পতি অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সেটা করতে গিয়ে যদি নাবালিকা মায়েরা নজরদারির বাইরে চলে যায়, তা হলে আরও বড় সঙ্কট তৈরি হবে। গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা নিয়ে নাবালিকাদেরও পরামর্শ দেওয়া যায় কি না, তা এ বার ভেবে দেখার সময় এসেছে।'