আধপেট খেয়ে দিন গুনছে শবররা, সরকার বলছে পাশে আছি !


পুরুলিয়া : খটখটে রোদ হোক বা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। সব ঋতুতেই তাদের ঠাঁই বলতে ছাউনি বা বেহাল মাটির বাড়ি। কারও সেটুকু নেই। রোজ খেতে পাওয়া তাদের কাছে সোনার পাথর বাটি। নেই চাষাবাদ, নেই কোনও স্থায়ী জীবিকা। ভিক্ষা করে বা অন্যের বাড়িতে কাজ করে যেটুকু আয় হয়, তাতেই কোনওরকমে টেনেটুনে চলে সংসার। মেলে না বার্ধক্য ভাতা, বেকার ভাতা, বিধবা ভাতার মতো বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাও। নেই ICDS সেন্টার। পুষ্টিগত খাবার থেকে বঞ্চিত শিশু ও গর্ভবতী মায়েরা। গ্রামে এখনও পৌঁছায়নি বিদ্যুতের আলো। কেরোসিন তেল কিনে হ্যারিকেন জ্বালানোর সামর্থ্যও নেই তাদের। গ্রামে ঢোকার জন্য রয়েছে কাঁচা রাস্তা। পানীয় জলের ব্যবস্থা নামমাত্র। আজ স্বাধীনতার ৭২ বছর পরেও পুরুলিয়া জেলার বেশ কয়েকটি শবর গ্রাম ঠিক এভাবেই ধুঁকছে।

লালগড়ের জঙ্গলখাস গ্রামের সাত শবরের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল রাজ্য রাজনীতি। বিরোধীদের দাবি, অনাহারে মারা গেছে তারা। কিন্তু, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, "অনাহারে কেউ ভোগেনি।" অনেকেই দাবি করছেন, মদ খেয়ে মৃত্যু হয়েছে শবরদের। এই ঘটনার পর পুরুলিয়া জেলার শবর জনজাতির জীবনযাত্রা খতিয়ে দেখতে ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি হাজির হন সেইসব গ্রামে। এই জেলারই হুড়া, পুঞ্চা, বলরামপুর, বান্দোয়ান, কেন্দা মানবাজার সহ বেশ কয়েকটি থানা এলাকায় প্রায় ২০০-২৫০ টি শবর পরিবারের বসবাস। পুরুলিয়া জেলার হুড়া থানার অন্তর্গত মতিপুর শবরপাড়া এলাকায় প্রায় ১৫-১৮টি পরিবার বাস করে। গ্রামে ঢুকতেই নজরে পড়ে বেহাল রাস্তা, প্লাস্টিকের ছাউনি দেওয়া ঘর। সেই বাড়ির অবস্থা এমনই যে কোনও সময় বাড়ি ধসে ঘটতে পারে বড়সড় দুর্ঘটনা। গ্রামে নেই নলকূপ। পানীয় জলের উৎস বলতে একটি কুয়ো। এখন চাষের সময়। তাই অন্যের বাড়ির ধান কেটে বা ধান ঝেড়ে যেটুকু আয় হয়, তা দিয়েই পেট চলে পরিবারের সদস্যদের। 

রাজ্যে পালাবদলের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী সহ শাসকদলের দাবি, রাজ্যজুড়ে বইছে উন্নয়নের জোয়ার। কিন্তু, কোনও এক অজানা কারণে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত শবর গ্রামগুলি। মতিপুর শবর পাড়ার বাসিন্দা শ্যামল শবর বলেন, "ভোটের সময় নেতা-মন্ত্রীরা অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। আর ভোট মিটে গেলেই কারোর দেখা মেলে না।" গ্রামেরই অপর এক বাসিন্দা রাতুলা শবর সদ্য মা হয়েছেন। এই অবস্থায় পুষ্টিগত খাবার থেকে তিনি ও তাঁর ছোটো সন্তানও বঞ্চিত। তিনি বলেন, "আমাদের কষ্টের কথা কেউ শুনতে চায় না। কিছুই তো পাচ্ছি না। অভাবের সংসারে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও করাতে পারি না। সবাই কাজ করে যে সামান্য পয়সাকড়ি পায়, তা দিয়েই সংসার চলে। আমরা চাই সরকার আমাদের জন্য কিছু সুযোগ দিক।" 

রাহেরডি শবর পাড়ার বাসিন্দা দুলাল শবরের প্রশ্ন, "চাষ নেই, কাজ নেই, সরকারি সহযোগিতা নেই। কী করে বাঁচব আমরা?" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অস্ফুটে তিনি বলেন, "গ্রামে কেউ লেখাপড়াও জানে না। তাই সরকারের সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে আসার সামর্থ্যও নেই। আমাদের অবস্থা একইরকম রয়ে গেছে।" 

পুঞ্চা এলাকার এক বিশিষ্ট সমাজসেবী অরূপ মুখোপাধ্যায় কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল পদে কর্মরত। তাঁর কথায়, "শবরদের জীবনযাত্রা খুব কঠিন। সরকার এদের জন্য সহযোগিতা পাঠালেও মাঝপথ থেকে সব উধাও হয়ে যায়। এদের কাছে পৌঁছায় না কিছু। আজও রাস্তাঘাট, পানীয় জল, ঘরবাড়ি, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, বেকার ভাতা কিছুই পায়নি এরা।" তাঁর দাবি, "শবর জনজাতির দিকেও একটু নজর দিক সরকার। একটু সহযোগিতা পেলে এরা আর কোনওদিন না খেতে পেয়ে মরবে না।" 

যদিও অভিযোগ উড়িয়ে দেন পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাত। তিনি বলেন, "এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য রাজ্য সরকার সবসময় এগিয়ে এসেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কেউ কোনও কাজ করেননি।"