স্নাতক বৃদ্ধা ভিক্ষা করেন হাওড়া স্টেশনে, আগলে রেখেছেন হকার ‘ছেলে’রা

অসহায়: হাওড়া স্টেশনে সবিতা মুখোপাধ্যায়।

সবাই আছে তাঁর। কিন্তু পাশে কেউ নেই।
তাই গত কয়েক বছর ধরে হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মই হয়ে গিয়েছে তাঁর ঘর। পরনে দীর্ঘদিনের না কাচা শাড়ি। পক্ষাঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁ পা টানতে টানতে নিত্যদিন একমুঠো ভাতের জন্য হাত পাততে হয় তাঁকে। অথচ এমনটা হওয়ার তো কথা ছিল না! হাওড়ার বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজের কলা বিভাগের সেই স্নাতকের নিজের ঘর ছিল, সন্তান ছিল।

বছর ছিয়াত্তরের সবিতা মুখোপাধ্যায়ের আদত বাড়ি হাওড়ায়। সবিতাদেবীর বিয়ে হয়েছিল উচ্চপদে কর্মরত এক ব্যক্তির সঙ্গে। বিয়ের সূত্রে তিনি বহরমপুরে চলে যান।

সেখানেই চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাঁদের সুখের সংসার চলছিল। ঘটনাচক্রে এক দিন খুন হয়ে যান তাঁর স্বামী। এর পরেই ভাঙন ধরে পরিবারে। কী ভাবে? প্রশ্ন শুনে কয়েক মিনিট নীরব সবিতাদেবী। কিছু বলার চেষ্টা করতেই ঝাপসা চোখ বেয়ে নেমে এল জল।

মাথা নিচু করে ময়লা আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ফের ধরা গলায় কথা শুরু করলেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পরে বহরমপুরের পাট চুকিয়ে তিনি রুজির সন্ধানে হাওড়ার বাপের বাড়িতে ফিরে আসেন। সেখান থেকেই চাকরি খোঁজা শুরু করেন। অবশেষে অনেক চেষ্টা করে এক ঠিকাদারের থেকে হাওড়া স্টেশনের শৌচাগার দেখভালের দায়িত্ব পান। তাঁর বেতন স্থির হয় মাসিক ছ'হাজার টাকা। তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত আরও চারটি মুখ। ফলে সবটা সামলে ওঠা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল সবিতাদেবীর পক্ষে। এরই মধ্যে দুই ছেলে এবং এক মেয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। স্বামী আর তিন সন্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে তিনি চলে যান হুগলির কোন্নগরে। সেখানেই ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন তিনি। ছোট মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে বড় করেন।

এক দিন সেই মেয়ে বিয়ে করে চলে যান গুয়াহাটি। সবিতাদেবীর আক্ষেপ, এর পরে তাঁর সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ হয়নি।

বৃদ্ধা বলে চলেন, ''চাকরি করে যে সামান্য বেতন পেতাম, তাই দিয়ে কোন্নগরের ঘর ভাড়া মিটিয়ে একার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু রেলস্টেশন সাজানোর সময়ে শৌচাগার ভাঙা পড়লে আমার সেই কাজও চলে যায়।'' সবিতাদেবী জানান, ভাড়া বাকি পড়ে থাকায় কোন্নগরে ফেরার পথও এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। অগত্যা হাওড়া স্টেশনেই আশ্রয় নিতে হয় তাঁকে। কিছু দিন স্টেশনে নিমের দাঁতন বিক্রি করেন। কিন্তু পুঁজির অভাবে সে ব্যবসা চলল না। পক্ষাঘাতে অসুস্থ হওয়ায় হাঁটাচলাও বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে ভিক্ষাবৃত্তিই তাঁর বাঁচার রাস্তা হয়ে যায়।

এত লড়াইয়ের পরেও ফের 'গৃহচ্যুত' হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনি। কথা বলার সময়ে পাশে দাঁড়ানো এক যুবক বললেন, ''আরপিএফ আর জিআরপি-র ভয় তো আছেই। তবে আমরা ওঁর পাশে সকলে আছি। মাকে কিছুতেই সরাতে দেব না।'' স্টেশনের ফেরিওয়ালা ও জিআরপি-র সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরাই এখন তাঁর ছেলে-মেয়ের মতো। করুণ হেসে বললেন, ''ওঁরাই আমাকে 'মা' বলে ডাকেন। ওঁদের দেখে কষ্ট ভুলে থাকি।''

হাওড়ার রেলপুলিশ সুপার নীলাদ্রি চক্রবর্তী বলেন, ''এই ধরনের ঘটনা নজরে এলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। প্রয়োজনে আশ্রয়হীনকে কোনও হোমে পাঠানো হয় বা পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ওই মহিলার ক্ষেত্রে ঠিক কী করা হবে তা ওঁর সঙ্গে কথা বলে স্থির করব।''

সব শুনে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলছেন, ''সন্তান না হয়েও যাঁরা ওঁকে মা বলে ডাকেন, আমি তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই। পরিবার না থাকলে, এ ভাবে অন্তত আমরা পাশে দাঁড়াতে পারি। তাতে ওই বৃদ্ধা কিছুটা কষ্ট ভুলে থাকতে পারবেন। পরিজন না থাকলেও সমাজ তাঁর বৃহৎ পরিবার, এই বোধ দিতে সরকার বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।''