পুলিশের শাস্তি চায় ‘নন্দীগ্রাম’


ঘনশ্যাম ঢাকাড়? তার মানে আপনি বাদোয়ানের রেখা ঢাকাড়ের বাড়ি খুঁজছেন? 

প্রশ্ন শুনে বললাম, গ্রামের নাম জানা নেই। শুনেছি, পঞ্চায়েতের নাম দালোদা। কিন্তু রেখা ঢাকাড় কে? মাঝবয়সি ট্রাক্টর চালকের চটজলদি জবাব, 'ওই যে মুখ্যমন্ত্রীকে যিনি মুখের উপর বলেছেন, 'আমি আপনাকে দু-কোটি টাকা দিচ্ছি। আপনি আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন?' কথাটা শুনে মুখ্যমন্ত্রী কেমন থতমত খেয়েছিলেন, তা-ও খানিক অভিনয় করে দেখালেন ছাপোষা ট্রাক্টর চালক। 

সোমবার সকালে ইন্দোর-মন্দসোর হাইওয়ে থেকে ট্রাক্টর চালকের পথনির্দেশিকা মেনে প্রায় ৪০ কিলোমিটার গাড়ি ছুটিয়ে বাদোয়ানে পৌঁছে এক রাস্তার মোড়ে ঘনশ্যাম ঢাকাড়ের বাড়ি খোঁজ করতে এগিয়ে এলেন গ্রামের এক প্রৌঢ়। মহিলা নিজেই পরিচয় দিলেন, 'ম্যায় রুকমা বাঈ। ইস গাঁও কি সরপঞ্চ।' ঘনশ্যাম ঢাকাড়ের বাড়ি খুঁজছি শুনে একজনকে ডেকে বললেন, 'সাহাব কো রেখাজি কি ঘর পৌঁছাদো।' 
গ্রামে ঢোকার মুখেই বসেছে ঘনশ্যামের মূর্তি। শহিদ বেদির গায়ে লেখা, 'জয় কিষান'। কিন্তু পুলিশ হেফাজতে ঘনশ্যামের মৃত্যুর পর থেকেই আলোচনায় তাঁর স্ত্রী। সদ্য বিধবা যে কোলে দুধের শিশুকে নিয়ে শোক জানাতে আর ক্ষতিপূরণের চেক দিতে আসা মুখ্যমন্ত্রীর মুখের উপর কথাটা বলে দেবেন, কেউ কল্পনাই করতে পারেননি।

বাদোয়ানের উল্টোদিকের গ্রাম লোধ। হাইওয়ে পেরিয়ে যেতে হয়। জমির উর্বরতা তো আছেই, চম্বল নদী আর রানিসাগর বাঁধের কল্যাণে মধ্যপ্রদেশের এই এলাকায় খেতে সোনা ফলে। সর্ষে, মেথি আর গমের খেত দেখে মনে হচ্ছিল যেন হুগলি, বর্ধমানের গ্রামে এসেছি। এই গ্রামের শহিদের নাম বছর পঁচিশের সত্যনারায়ণ ঢাঙর। বাড়ির পাশেই পাথরের মূর্তি বসেছে তাঁর। ভরদুপুরে ভাতের থালা সরিয়ে উঠে এলেন সত্যনারায়ণের মা ভানোয়ারি বাঈ। তাঁর একটাই কথা, 'মেরা নির্দোষ লড়কা কো কিউ গোলি মারা পুলিশ?' 

প্রশাসনের দাবি, বৃদ্ধা এবং তাঁর স্বামীর নামে ৫০ লাখ টাকা করে ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেওয়া হয়েছে। ঘনশ্যাম ঢাকাড়ের ক্লাস টু-তে পড়া পুত্র রুদ্র আর বছর দেড়েকের মেয়ে হিমাংসির নামেও ৩৩ লাখ টাকা করে ফিক্সড ডিপোজিট আছে। বাবার মৃত্যুর দিনেই জন্ম হিমাংসির। রেখার নামে জমা আছে বাকি ৩৪ লাখ। রুদ্র, হিমাংসিরা একদিন জানবে তাঁর মায়ের স্বামীর মৃত্যুশোক কোটি টাকায় কিনে নিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। রেখার কথায় সায় দিয়ে গ্রামবাসীরা অনেকেই বলেন, একটা পরিবারও হাতে চেক নেয়নি। প্রশাসনের লোকেরা জবরদস্তি অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে জনতা দাবি তোলে, পুলিশের শাস্তি চাই। 

ক্ষতিপূরণ বাবদ কোটি টাকা করে পেয়েছে অভিষেক পাতিদার, ছেনরাম পাতিদার, পুনমচাঁদ পাতিদার এবং কানাইয়া পাতিদারের পরিবারও। এ ছাড়াও আছে পরিবার পিছু একজনের সরকারি চাকরি, পাকা বাড়ি এবং সন্তানের পড়াশুনোর খরচ। পুলিশের গুলিতে মৃতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণে এমনই নজির গড়েছেন মধ্যপ্রদেশের তিনবারের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। ব্যাঙ্ক থেকে সুদের টাকা তোলা এবং ক্ষতিপূরণের টাকায় আর কী কী করা যেতে পারে তা নিয়ে সরকারি আধিকারিকরা রীতিমতো ক্লাস নিয়েছে সাতটি পরিবারের। 

শিবরাজের এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। কারণ ফসলের দাম বাড়ানোর দাবিতে রাস্তা অবরোধকারী কৃষকদের হটাতে তাঁর পুলিশ এবং আধা সেনা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মন্দসোরকে বাংলার নন্দীগ্রাম, ওডিশার কলিঙ্গনগরের সঙ্গে এক বন্ধনীতে এনে ফেলেছে। শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, বিজেপি শাসিত প্রতিবেশী রাজ্য গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়েও মন্দসোরের কৃষক বিদ্রোহের আঁচ পড়তে শুরু করে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে তাই ফসলের দাম নিশ্চিত করতে ভাবান্তর যোজনা (বাজার দলের সমান সরকারি মূল্য) ঘোষণা করেছেন। 

গত বছর ৬ জুন গুলিচালনার ঘটনার পর থেকে ছয়বার মন্দসোর গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তাতে ক্ষতে পুরো প্রলেপ পড়েনি। ডাল, গম, সব্জি, মশলা মিলিয়ে মন্দসোরের জমিতে ১০৪ রকম ফসল হয়। ফসলের দাম আর পুলিশের ভূমিকা নিয়ে কৃষকের ক্ষোভ উস্কে দিতে গুলিচালনার বর্ষপূর্তিতে ঘুরে গিয়েছেন রাহুল গান্ধী। তার উপর সরকারি তদন্ত কমিটি জানিয়ে দিয়েছে, আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালিয়েছিল পুলিশ, আধাসেনা। 

কৃষকদের ক্ষোভ কাজ লাগিয়ে বিজেপিকে এ বার জোর ধাক্কা দেওয়া যাবে, দাবি মন্দসোরের মানুষ প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মুকেশ কালার। রাহুল গান্ধীকে প্রচারেও মন্দসোর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কংগ্রেস। কিন্তু রাজ্য কংগ্রেস রাহুলের মন্দসোর সফর চূড়ান্ত না-করলেও কংগ্রেস সভাপতি যাচ্ছেন ধরে নিয়ে ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে দিয়ে মন্দসোরের কৃষকদের ক্ষোভে প্রলেপ দিতে প্রস্তুত হচ্ছে বিজেপি। গড় অক্ষত থাকবে, আশাবাদী বিজেপির কৃষক নেতা বংশীল গুর্জর।