উঠোনে শেকল বাঁধা স্বামী, চিকিৎসার খরচ জোগাতে ৬০ বয়সে পরিচারিকা হলেন অলোকা


কলকাতা থেকে দূরত্ব সাড়ে চারশো কিলোমিটারের একটু বেশি। মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের লখনা বাগান। সোজা চলে যান অলোকা দাসের বাড়ি। দেখা যাবে প্রায় একটি স্তূপের আকৃতি নেওয়া বাড়ির সামনের উঠোনে বাঁশের সঙ্গে শেকল বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। নাম লক্ষ্মণ দাস। বয়স ৬৫।

দুই বছর ধরে কিছু খেয়াল করতে পারেন না লক্ষ্মণ। মাঝে-মাঝে বিদ্যুৎ-এর ঝলক-এর মতো স্মৃতিগুলো ফেরে। তারপর ফের যেন তারা হারিয়ে যায় কোনও অন্ধকারে। ফলে সারাক্ষণই অসংলগ্ন কথা বলতে থাকে লক্ষ্মণ। দিন-আনা দিন-খাওয়া পরিবারের বৃদ্ধ লক্ষ্মণের আয়ই ছিল একমাত্র ভরসা। ২ পুত্র সন্তান থাকলেও তাঁদের নিজ নিজ সংসার এবং তার স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষাতেই তাঁদের প্রাণপাত অবস্থা।

এই বাড়়িতে লক্ষ্মণ এবং তাঁর স্ত্রী অলোকার বাস। ফলে লক্ষ্মণের মানসিক স্থিরতা হারিয়ে যাওয়ায় সংসারের স্থিতাবস্থাও হারিয়ে গিয়েছে। লক্ষ্মণের চিকিৎসারক খরচ জোগানো থেকে রোজ বেঁচে থাকার নূন্যতম ব্যবস্থাটুকু করতেই হিমশিম অবস্থা অলোকার। লক্ষ্মণকে বহরমপুর মানসিক হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিলেন অলোকা। কিন্তু, সেখানে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি কপর্দকশূন্য অলোকা। স্বামী লক্ষ্মণকে নিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি হরিশ্চন্দ্রপুরে।

বিপত্তির শেষ নেই। জঞ্জাল-আবর্জনা ঘেঁটে বেড়াচ্ছেন লক্ষ্মণ। মাঝে মাঝে লোক জন-এর কাছে পেতে হচ্ছে পাগলের তকমা। এলাকার অনেকে আবার পাগল ভেবে তাঁকে তাড়াও করছেন। লক্ষ্মণকে স্থানীয় এক চিকিৎসকও দেখিয়েছেন অলোকা। কিন্তু করাতে হবে সিটি স্ক্য়ান। তাতেও অনেক অর্থ দরকার। তাই আপাতত লক্ষ্মণকে বাড়ির উঠোনেই শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। নুন-আনতে পান্তা ফুরনোর সংসারে শেষমেশ পরিচারিকার কাজ ধরেছেন বছর ষাটের আলোকা। তিল-তিল করে চেষ্টা করে চলেছেন স্বামীর চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করতে। তিনি যখন কাজে বের হন তখন স্বামী লক্ষ্মণকে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে শেকল দিয়ে লক্ষ্মণকে বেঁধে তাতে তালা ঝুলিয়ে দেন। ছেলে-দের কাছে হাত পাতেননি অলোকা। কারণ, ছেলেরা যে বাবা-মা-কে সাহায্য করবে সে অবস্থা তাঁদের নেই বলেও দাবি করেছেন দুই পুত্রবধূ।

২০১৭ সালে হরিশ্চন্দ্রপুরে যে বন্য়া হয়েছিল তাতে ভিটে-মাটি ভেসে গিয়েছিল অলোকার। সরকারি সাহায্য যেটুকু মিলেছিল তাতে বাড়ি-ঘর আর নতুন করে তৈরি করা যায়নি। কোনওমতে একটা স্তূপের চেহারা নিয়েছে অলোকা ও লক্ষ্মণের বাড়ি।

এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস নেতা তথা হরিশ্চন্দ্রপুর গ্রামপঞ্চায়েতর সদস্য দ্রোণাচার্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওই লক্ষ্মণ দাসের চিকিৎসায় অলোকাকে কিছু আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু, সকলে মিলে এই উদ্যোগে সামিল না হলে কিছু করা মুশকিল। তবে, পঞ্চায়েত থেকে যাতে চিকিৎসায় সাহায্য করা যায় তার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য তথা বিজেপি হরিশ্চন্দ্রপুর ১-এর সভাপতি রূপেশ আগরওয়ালও লক্ষ্মণের চিকিৎসার জন্য যথাসাধ্য সাহায্য়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকের ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক এম ডি লামা জানিয়েছেন, লোক পাঠিয়ে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। প্রয়োজনে সরকার থেকে সাহায্যের ব্যবস্থা করবেন।