‘আপনারা জিতে গেলেন, আমি হেরে গেলাম’, ফাঁসির আগে বলেছিল কাসভ


ভারতীয় আইনব্যবস্থা এমনই যে, কিছুতেই তার ফাঁসি হবে না। এমনটাই বিশ্বাস ছিল মুম্বইয়ের ২৬/১১ হামলার মূল সন্ত্রাসবাদী আজমল আমির কাসভের। যদিও সেই বিশ্বাস টলে গিয়েছিল ফাঁসির ঠিক আগের দিন।

ওই দিন তাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য আর্থার রোড জেলের বিশেষ সেল থেকে ইয়েরওয়াড়া জেলে নিয়ে যেতে এসেছিলেন ২৬/১১ হামলার মূল তদন্তকারী অফিসার রমেশ মহালে। হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রমেশ জানিয়েছেন, ''প্রথম বারের জন্য তখনই মৃত্যুভয় ফুটে উঠেছিল কাসভের চোখেমুখে। অস্ফূট স্বরে সে বলে উঠেছিল, আপনারা জিতে গেলেন, আমি হেরে গেলাম। তার পরই একদম চুপ করে গিয়েছিল পাকিস্তান থেকে আসা এই কিশোর জঙ্গি।'' আজমল আমির কাসভকে চার বছর ধরে জেরা করার এ রকমই নানান মুহূর্ত সামনে নিয়ে এলেন মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের তৎকালীন প্রধান রমেশ মহালে।

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর হামলার সময়ই মুম্বই পুলিশের ক্রাইম ব্রাঞ্চের প্রধান ছিলেন রমেশ মহালে। ২৬/১১ হামলার তদন্তের ভার ছিল তাঁর হাতেই। কাসভকে ধরার পর প্রথম ৮১ দিন তাকে নিজেদের কাছেই রেখেছিল ক্রাইম ব্রাঞ্চ। তার পরেই কাসভকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর্থার রোড জেলের বিশেষ ভাবে বানানো বুলেটপ্রুফ কারাগারে। প্রায় চার বছর ধরে কাসভের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল রমেশ মহালের। বিভিন্ন সময় কাসভের নানা মন্তব্য চমকে দিত তাঁকে। ক্রাইম ব্রাঞ্চে প্রায় দেড় মাস কাটানোর পর তার মন্তব্য ছিল, ''ভারতীয় আইনব্যবস্থায় সহজে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয় না। মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করার আট বছর পরও আফজল গুরুর ফাঁসি দিতে পারেনি ভারত।'' ২০০৮ সালে এই কথা বলার সময় কাসভের চোখেমুখে প্রত্যয়ের ছাপ ফুটে উঠত বলে জানাচ্ছেন রমেশ মহালে।

মাত্র ১৭ বছরের ওই কিশোরের বুদ্ধি অবাক করে দিত রমেশ মহালেকে, এমনটাই দাবি করেছেন তিনি। তদন্তের প্রথম দিনই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, সহজ রাস্তায় কাসভের কাছ থেকে কথা বার করা যাবে না। তাই কাসভের সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে কাসভকে দু'সেট জামাকাপড় উপহার দিয়েছিলেন তিনি।

উল্টোপাল্টা উত্তর দিয়ে কী ভাবে কাসভ তদন্তকারী অফিসারদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করত, সেই সবও সামনে এনেছেন মহালে। যেমন, আদালতে বয়ান দেওয়ার সময় সে হঠাৎই এক দিন বলে, ''আমি পাকিস্তানি নাগরিক। অমিতাভ বচ্চনকে দেখতে ভারতে এসেছি। অমিতাভের জুহু বাংলোর সামনে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখনই আমাকে ধরে ফেলে ভারতীয় গোয়েন্দারা। তার পরেই আমাকে তুলে দেওয়া হয় মুম্বই পুলিশের হাতে। লক আপে ঢোকানোর আগে আমার হাতে গুলি করে পুলিশ। চার দিন পর  ২৬/১১ হামলার সঙ্গে ওঁরা আমাকে জড়িয়ে দেয়।''

২০১২ সালের ১১ নভেম্বর বিশেষ আদালতে ফাঁসির সাজা হয় কাসভের। ১৯ নভেম্বর গভীর রাতে ওই জঙ্গিকে আর্থার রোড জেল থেকে ইয়েরওয়াড়া জেলে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল রমেশ মহালের কাঁধেই। কাসভের কক্ষে গিয়ে এই ২১ বছরের বন্দিকে রমেশ বলেছিলেন, ''কী বলেছিলে, মনে পড়ছে? চার বছর হতে এখনও সাত দিন বাকি। তার আগেই তোমাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।''

এর পরই প্রথম বারের জন্য কাসভের মুখে মৃত্যুভয় দেখতে পেয়েছিলেন রমেশ মহালে। অস্ফুট স্বরে কাসভ বলে উঠেছিল, ''আপনি জিতে গেলেন, আমি হেরে গেলাম।'' ২১ নভেম্বর সকালে পুণে যাওয়ার পথে সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তায় একটিও কথা বলেনি সে। তার সব আত্মবিশ্বাস টলে গিয়েছিল সে দিন, এমনটাই দাবি রমেশের।

২১ নভেম্বরই ফাঁসি দেওয়া হয় কাসভকে। রমেশ মহালে আর কাসভের চার বছরের যোগাযোগ শেষ হয়েছিল সে দিনই। কাসভের ফাঁসি হয়েছে জানার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি। এটা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা খুশির মুহূর্ত, এমনটাই জানিয়েছেন ২০১৩ সালে অবসর নেওয়া মুম্বই পুলিশের এই দুঁদে অফিসার।