আদিবাসী পর্যটনের ‘বাড়াবাড়ি’ই কি বিপদ ডেকে আনছে আন্দামানে?


অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনার কৌতূহলই কি আন্দামানে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিদেশি পর্যটকদের? আধুনিক সভ্যতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন আদিবাসীদের শিকার হতে হচ্ছে কৌতূহলীদের? আর সেই কৌতূহলকে উস্কে দিয়ে পকেটে বাড়তি কড়ি ভরার নেশায় কি মদত দিয়ে যাচ্ছেন আন্দামানের ট্যুর অপারেটররা? ভ্রমণ-আয়োজকরা? বাড়তি রাজস্ব আদায়ের মোহে কি পর্যটকদের কৌতূহলকে হাওয়া-বাতাস দেওয়ার আয়োজনে ঘাটতি নেই আন্দামান প্রশাসনেরও?
এ মাসে আন্দামানের নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে আদিবাসী সেন্টিনেলিজ সম্প্রদায়ের ছোড়া বিষাক্ত তিরে ২৭ বছর বয়সী এক মার্কিন পর্যটক জন অ্যালেন চাউয়ের মৃত্যুর পর এই প্রশ্নগুলিই ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র।

শীর্ষ আদালতের নির্দেশ ও আন্দামান প্রশাসনের নিয়মকানুন অনুযায়ী, আন্দামানের যে দ্বীপগুলিতে পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, নর্থ সেন্টিনেল তাদের অন্যতম। পুলিশ জানাচ্ছে, সেই নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপে নেমে আধুনিক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সেন্টিনেলিজ আদিম জনজাতির সঙ্গে মোলাকাতের জন্য লাগোয়া সমুদ্রে ৬ জন মৎস্যজীবীকে মোট ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিলেন ওই মার্কিন পর্যটক। যার অর্থ, ঘুষ দিয়ে ওই নিষিদ্ধ দ্বীপগুলিতে পর্যটকদের যাওয়ার চল রয়েছে। আর সেটা ওই মার্কিন পর্যটকের জানা ছিল!

নৃতত্ত্ববিদরা জানাচ্ছেন, আন্দামানে রয়েছে পাঁচটি 'বিশেষ ভাবে বিপন্ন' আদিবাসী সম্প্রদায়। জারোয়া, নর্থ সেন্টিনেলিজ, গ্রেট আন্দামানিজ, ওঙ্গে ও শোম্পেন। এদের মধ্যে জারোয়া আর সেন্টিনেলিজরা আধুনিক সভ্যতা থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন।

আর তাই পর্যটকদের কৌতূহল এতটাই যে, জারোয়া ও সেন্টিনেলিজরা যেখানে থাকেন, সেই দ্বীপগুলিতে যাওয়ার জন্য ফিবছর আন্দামানে আসেন গড়ে ৫ লক্ষ পর্যটক। বিদেশি পর্যটকদের জন্য অবশ্য চলতি বছরের গোড়ায় এ ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। বিদেশিদের জন্য এমনকি কয়েকটি নিষিদ্ধ এলাকাতেও ঢোকার জন্য দেওয়া শুরু হয় রেস্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট (আরএপি বা 'র‌্যাপ')। তার জন্য বেছে নেওয়া হয় ২৯টি দ্বীপ। যার ৯টি রয়েছে নিকোবরে, ২টি আন্দামানে। নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপ তাদেরই অন্যতম।

জারোয়ারা থাকে মধ্য ও দক্ষিণ আন্দামানের এক কিলোমিটারেরও বেশি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। খুব কাছ থেকে তাদের দেখতে পর্যটকরা বাসে চেপে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে যান বারাতং-এ। আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড ধরে। দু'ঘণ্টার পথ।

কিন্তু সেখানে পর্যটকদের টানতে পুলিশ ও প্রশাসন নানা ফন্দি আঁটে। বন্দুক দেখিয়ে পর্যটকদের সামনে নাচতে বাধ্য করা হয় জারোয়া রমণীদের। ওই রকম একটি ভিডিয়ো দেখার পর সুপ্রিম কোর্ট ওই সড়কপথে পর্যটকদের যাওয়ার উপর জারি করে নিষেধাজ্ঞা, ২০১৩ সালে।

কিন্তু তার পর 'অন্য পথ' ধরে প্রশাসন, অভিযোগ আন্দামান নিকোবর এনভায়রনমেন্ট টিমের সদস্য মনীশ চণ্ডীর। তাঁর কথায়, ''আদালতের ওই নির্দেশের পর প্রশাসন চালাকি করে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে বারতং পর্যন্ত ফেরি সার্ভিস চালু করে পর্যটকদের জন্য। সেটা আদালতকে দেখানোর জন্য যে, প্রশাসন ওই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে যাওয়ার বিকল্প রাস্তা বানিয়েছে। এ বার পর্যটকরা ফেরিতে যাবেন নাকি, সড়ক পথে, সেটা তাঁদের ব্যাপার। পর্যটকদের বেশির ভাগই কৌতূহলের বশে যান সড়ক পথেই।''

৫০ কিলোমিটার দূরে থাকা নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের সঙ্গে সরাসরি কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থাই নেই পোর্ট ব্লেয়ারের। পুলিশ, উপকূল রক্ষীরা সেখানে কড়া নজর রাখে, যাতে কেউ নিরাপত্তার ফাঁক গলে ঢুকে না পড়েন ওই নিষিদ্ধ এলাকায়। কিন্তু চণ্ডীর কথায়, ''তার পরেও পর্যটকরা ঢুকে পড়েন ওই সব এলাকায়। ২০১৩-'১৪ সালে মুম্বইয়ের এক ব্যবসায়ী ঢুকে পড়েছিলেন একটি স্পোর্টস ফিশিং বোট নিয়ে। ধরাও পড়েছিলেন উপকূল রক্ষীদের হাতে।

আন্দামান প্রশাসনের আদিবাসী কল্যাণ দফতরের অধিকর্তা গোবিন্দ রামের কথায়, ''এই সব ঘটনার কিছু কিছু আমরা জানতে পারি। অনেকটাই পারি না। মানুষের কৌতূহলের পায়ে আর কতটাই বা বেড়ি পরানো যায়? তবে আমরা চেষ্টা করে চলেছি, যাতে এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা কমানো যায়।''