রোহিতের রোশনাইয়ে নবাবি চালে সিরিজ জয় ভারতের


আসল দীপাবলির ধামাকা বোধ হয় একেই বলে। আমি যেখানে থাকি, সেখানে চারদিকে বাজির রোশনাই। কিন্তু সত্যিকারের রোশনাই দেখলাম লখনউয়ের মাঠে। রোহিত শর্মার ব্যাটিংয়ে।

লখনউয়ে রোহিত-রোশনাইয়ে ৭১ রানে জিতে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজও পকেটে পুরে ফেলল ভারত। ১৯৫ তাড়া করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থামল ৯ উইকেটে ১২৪ রানে। নবাবের শহরে নবাবি চালে সিরিজ জয় যাকে বলে।   

ভারতীয় ইনিংসের প্রথম ওভারটা মেডেন নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলার ওশেন থমাস। প্রথম তিন ওভারে ভারতের রান ছিল ১১। তখন মনে হচ্ছিল, দেড়শোর বেশি রান বোধ হয় উঠছে না। কিন্তু ব্যাট হাতে যে রোহিত ছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক কার্লোস ব্রাথওয়েট ওই সময় একটা ভুল করেন। পাওয়ার প্লে-র মধ্যে স্পিনার নিয়ে এলেন। তখনই ম্যাচটা ভারত ধরে নিল। 

রোহিতের খেলাটা পুরোপুরি পরিস্থিতি নির্ভর। যখন যে রকম প্রয়োজন, সে রকম ব্যাট করেন। এ দিনও তাই হল। সাবধানী শুরু। প্রথম ছ'বলে কোনও রান নেই। তার পরে যত ইনিংস এগিয়েছে, তত ব্যাট থেকে স্ট্রোকের ফুলঝুরি দেখা গিয়েছে। ৬১ বলে ১১১ রানে অপরাজিত থাকলেন। মারলেন আটটা চার, সাতটি ছয়। 

ভারত ওই রান তুলে দেওয়ার পরে আমার একটা জিনিসই দেখার ইচ্ছে ছিল। রোহিতের ব্যক্তিগত রানটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ টপকে যেতে পারে কি না! কোনও মতে সেটা করতে পারলেন ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানরা। ভারতীয় বোলারদের মধ্যে ক্রুণাল পাণ্ড্য ছাড়া সবাই দুটো করে উইকেট নিলেন। সুস্থ হয়ে দলে ফেরা ভুবনেশ্বর কুমারকে দেখে ভাল লাগল। দু'আঙুলের ডগায় বলটা ধরছেন। সেখান থেকেই ছাড়ছেন। ফলে পিচে পড়ার পরে বলের গতি অনেক কমে যাচ্ছে। ব্যাটসম্যানরাও ঠকে যাচ্ছেন। 

বিশ্বকাপে দলে থাকার ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে গেলেন খলিল আহমেদও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা দুই ব্যাটসম্যান শেই হোপ এবং শিমরন হেটমায়ারের উইকেট তুলে নিলেন খলিল। তবে হেটমায়ারের ক্ষেত্রে রোহিত একেবারে ঠিক জায়গায় ফিল্ডার রেখেছিলেন। ভারতীয় টিম পরিচালন সমিতি নিশ্চয়ই এত দিনে বুঝে গিয়েছে, হেটমায়ার মূলত মারে লংঅন, লংঅফ অঞ্চল দিয়ে। শিখর ধওয়ন লংঅনে ক্যাচটা নিয়ে নিলেন।    

স্কোরকার্ড

ভারত                                   ১৯৫-২ (২০)
ওয়েস্ট ইন্ডিজ                       ১২৪-৯ (২০)

ভারত
রোহিত শর্মা ন. আ.                 ১১১    •৬১
ধওয়ন ক পুরান বো অ্যালেন        ৪৩•৪১
ঋষভ ক হেটমায়ার বো পিয়ের       ৫•৬
কে এল রাহুল ন. আ.                 ২৬•১৪
অতিরিক্ত              ১০
মোট                              ১৯৫-২ (২০)
পতন: ১-১২৩ (ধওয়ন, ১৩.৬), ২-১৩৩ (ঋষভ, ১৫.২)।
বোলিং: ওশেন থমাস ৪-১-২৭-০, কিমো পল ৪-০-৩০-০, খ্যারি পিয়ের ৪-০-৪৯-১, কার্লোস ব্রাথওয়েট ৪-১-৫৬-০, ফ্যাবিয়ান অ্যালেন ৪-০-৩৩-১। 

ওয়েস্ট ইন্ডিজ
শেই হোপ বো খলিল                   ৬•৮
হেটমায়ার ক ধওয়ন বো খলিল   ১৫ • ১৪
ব্র্যাভো ক রোহিত বো কুলদীপ         ২৩•১৮
রামদিন ক রোহিত বো ভুবনেশ্বর ১০ • ১৭
নিকোলাস পুরান বো কুলদীপ            ৪•৩ 
কায়রন পোলার্ড ক ও বো বুমরা         ৬•১১
ব্রাথওয়েট ন. আ.                         ১৫•১৯
অ্যালেন রান আউট ক্রুণাল                 ০•১
কিমো পল ক রোহিত বো ভুবনেশ্বর   ২০•২১ 
খ্যারি পিয়ের ক ও বো বুমরা               ১•৪
ওশেন থমাস ন.আ.                                  ৮•৪
অতিরিক্ত              ১৬
মোট           ১২৪-৯ (২০)
পতন: ১-৭ (হোপ, ১.৩), ২-৩৩ (হেটমায়ার, ৫.২), ৩-৪৮ (ব্র্যাভো, ৭.৩), ৪-৫২ (পুরান, ৭.৬), ৫-৬৮ (পোলার্ড, ১০.৪), ৬-৮১ (রামদিন, ১৩.৪), ৭-৮১ (অ্যালেন, ১৩.৫), ৮-১১৪ (পল, ১৮.৪), ৯-১১৬ (পিয়ের, ১৯.২)।
বোলিং: ভুবনেশ্বর কুমার ৪-০-১২-২, খলিল আহমেদ ৪-০-৩০-২, যশপ্রীত বুমরা ৪-০-২০-২, ক্রুণাল পাণ্ড্য ৪-০-২৩-০, কুলদীপ যাদব ৪-০-৩২-২। 

অধিনায়ক রোহিতকেও এ দিন বেশ ভাল লাগল। তবে ব্যাটসম্যান রোহিত সবাইকে পিছনে ফেলে দিলেন। রোহিতের ইনিংসে একটা শটই দেখলাম ক্রিকেট কোচিং না মেনে এল। যে স্কুপ শটে ফাইন লেগ দিয়ে চার মেরে সেঞ্চুরি করলেন রোহিত। এই নিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে চারটে সেঞ্চুরি হয়ে গেল রোহিতের। যা বিশ্বরেকর্ড। একই সঙ্গে ভারতের হয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের মালিকও হয়ে গেলেন রোহিত।  

রোহিতের ইনিংসের তিনটে শট আমার চোখে এখনও ভাসছে। শুধু এই শটগুলো দেখার জন্যই মাঠে আসা যায়। প্রথমটা ওশেন থমাসের চতুর্থ ওভারের দ্বিতীয় বল। লেগের দিকে সরে গিয়ে, জায়গা বানিয়ে মিডঅফের ওপর দিয়ে ছয়। দ্বিতীয়টা চোদ্দতম ওভারে বাঁ হাতি স্পিনার ফ্যাবিয়ান অ্যালেনকে ডিপ মিডউইকেটের ওপর দিয়ে ওভার বাউন্ডারি। তিন নম্বরটাও এক বাঁ হাতি স্পিনারকে। রোহিতকে জায়গা বানাতে দেখে খ্যারি পিয়ের বলটা অফস্টাম্পের বাইরে একটু শর্ট ফেলেছিলেন। রোহিত ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে বলের কাছে পৌঁছে বোলারের মাথার ওপর দিয়ে গ্যালারিতে ফেলে দেন। বোলার অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে রোহিতের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। 

এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটা রীতিমতো মধ্যবিত্ত। এদের একমাত্র ভাল ক্রিকেটার ওই ওশেন থমাস। যে দেখলাম, ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটারের ওপর গতিতে বল করে চলেছেন। ইডেনে এই থমাসই ভারতকে চাপে ফেলে দিয়েছিলেন। তবে ইডেনের উইকেট বোলারদের সাহায্য করেছিল। পেসার, স্পিনার— সবাই সাহায্য পেয়েছিলেন। লখনউয়ের উইকেট কিন্তু অন্য রকম। ওখানে শট খেলা সহজ ছিল। যেটা পরে দেখলাম, ম্যাচের বিরতিতে শিখর ধওয়নও বললেন।

টস জিতে ভারতকে ব্যাট করতে পাঠায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুরুতেই বলেছি, তখন মনে হয়নি দু'শোর কাছাকাছি রান উঠবে। কিন্তু রোহিতের মোহময় ব্যাটিং, ধ্রুপদী ব্যাটিং, ক্ল্যাসিকাল ব্যাটিং ভারতকে গলি থেকে রাজপথে পৌঁছে দিল।