জগদীশচন্দ্রকে অপমান করা তাবড় বিজ্ঞানীদের ‘ভুল’ ধরিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্সিরই ৫ অধ্যাপক


কলকাতা: উদ্ভিদের প্রাণ আছে, আছে অনুভূতিও। জগদীশচন্দ্র বসুর যুক্তি যে অকাট্য ছিল, নেটিজেনদের দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে সেটাই নতুন করে প্রমাণ করলেন কলকাতার পাঁচ অধ্যাপক। যে ধ্রুব সত্যকে তখন উপেক্ষা করেছিলেন পশ্চিমী দুনিয়ার অনেক বিজ্ঞানী। এমনকী অনেকে তাচ্ছিল্যও করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুর এই আবিষ্কার নিয়ে। পরবর্তীকালে তাঁর সেই আবিষ্কার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও প্রাক্তনীর 'অপমান'-এর জবাব দিতে গবেষণা শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্সির পাঁচ অধ্যাপক। তাঁরা প্রমাণ করেছেন, তখনও জগদীশচন্দ্র বসুর যুক্তি অকাট্য ছিল, এখনও আছে। কারণ, আচার্য তাঁর পরীক্ষা করেছিলেন কলকাতার জল দিয়ে। বিদেশের গবেষণাগারে বিশুদ্ধ জল ব্যবহার করে যা দুনিয়ার তাবড় বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে পারেননি।

আদতে পদার্থবিদ্যার বিজ্ঞানী হলেও বরাবরই অন্যান্য ক্ষেত্রের গবেষণাতেও সমান আগ্রহ ছিল জগদীশচন্দ্র বসুর। সেই আগ্রহবশতই গাছের অনুভূতি রয়েছে কি না, নিজের বানানো যন্ত্র দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন সাফল্যও। কিন্তু পশ্চিমী দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা তা মেনে নিতে চাননি। উল্টে বিভিন্নভাবে জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণাকে ব্যঙ্গ করে গিয়েছেন।

অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ধীরে ধীরে জগদীশচন্দ্র বসুর ওই তত্ত্বেই সিলমোহর দিয়েছিল বিজ্ঞান দুনিয়া। তবু প্রাক্তনীর এই 'অপমান' কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি বর্তমানে প্রেসিডেন্সিতে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত সুপ্রিয়কুমার দাস, স্নিগ্ধা পালচৌধুরি (ভূ-তত্ত্ব বিভাগ), দেবাশিস দত্ত, রবীন্দ্রনাথ গায়েন (পদার্থবিদ্যা বিভাগ) এবং অভিজিৎ দে'রা (জীববিদ্যা বিভাগ)। সঙ্গে ছিলেন এমএসসি পড়ুয়া শরণ্যা নস্করও। কেন সেই সময় পশ্চিমী দুনিয়ার বিজ্ঞানীরা জগদীশচন্দ্রের গবেষণা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছিলেন, সেই উত্তর তাঁরা খুঁজতে শুরু করেন বছর দুয়েক আগে। জগদীশচন্দ্র বসুর মডেলকে অনুসরণ করে তাঁরই বাছাই করা বন-চাড়াল গাছকে বেছে নেন তাঁরা। কলকাতা ও তার সংলগ্ন এলাকার ১১টি জায়গায় পরীক্ষা চালান তাঁরা। প্রত্যেক জায়গাতেই জলের তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তৈরি করে বন-চাড়াল গাছ আধঘণ্টা ধরে রেখে দেন অধ্যাপকরা। তাতে দেখা যায়, মূলত এখানকার জলে বেশি মাত্রায় থাকা সোডিয়াম আয়নের জন্যই কলকাতায় বসে গাছেদের অনুভূতির প্রমাণ পেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র। বিদেশে গবেষণাগারের বিশুদ্ধ জলে পরীক্ষা করে যা জানতেই পারেননি পশ্চিমী দুনিয়ার তাবড় বিজ্ঞানীরা। এখনকার গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গঙ্গার জলে গাছেদের মধ্যে সর্বাধিক অনুভূতির প্রকাশ মেলে। জগদীশচন্দ্রের নিজের তৈরি যন্ত্রের 'মডেল' সোর্স মিটার ব্যবহার করেই পাঁচ অধ্যাপকের এই সাফ঩ল্য সম্প্রতি 'কারেন্ট সায়েন্স' জার্নালে প্রকাশিতও হয়।

অথচ এই গবেষণাকে কেন্দ্র করে সেই সময়ে জগদীশচন্দ্রকে বিভিন্নভাবে অপমানিত করা হয়েছিল। ১৯২২ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক খবর অনুযায়ী, বিশিষ্ট উদ্ভিদবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল ট্রেম্বলি ম্যাকডুগাল জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বলেছিলেন, এই ভারতীয় 'ভেল্কিবাজ' কল্পনাপ্রসূত যে তত্ত্ব খাড়া করেছেন, তা প্রকৃতিবিদদের মধ্যে জনপ্রিয় হলেও, তাঁরা কেউই গাছেদের শারীরবৃত্তীয় খুঁটিনাটি সম্পর্কে কিছু জানেন না। জগদীশচন্দ্র গাছেদের মধ্যে 'আত্মা' থাকার যে দাবি করেছেন, তা তাঁর শিশুসুলভ ধারণা থেকে এসেছে। ১৯২৭ সালে বিশ্বের বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা 'সায়েন্স'-এ ম্যাকডুগালকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়, 'গাছেদের হৃদস্পন্দন থাকার যে দাবি জগদীশচন্দ্র করেছেন, তা তাঁর রোম্যান্টিক ভাবনা থেকে এসেছে এবং যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই'। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক জর্জ জেমস পিয়ার্স ১৯২৭ সালে লিখেছিলেন, জগদীশচন্দ্রের জীববিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহ অসীম। কিন্তু, তাঁর মস্তিষ্ক এই সংক্রান্ত সঠিক গবেষণার পক্ষে উপযুক্ত নয়। বিখ্যাত সা঩য়েন্টিফিক অ্যামেরিকান‌঩সের অন্যতম সদস্য এ জি ইঙ্গালস্‌ চিঠি লিখে ম্যাকডুগালকে জানিয়েছিলেন, হিন্দু বন্ধু জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে সঠিক বিশ্লেষণের জন্য ধন্যবাদ। জগদীশচন্দ্রের লেখা যাতে কোথাও প্রকাশিত না হয়, সেবিষয়ে তিনি সতর্ক থাকবেন বলে আশ্বস্তও করেছিলেন।

এঁদের প্রত্যেককেই কিন্তু পরবর্তীকালে ঢোঁক গিলতে হয়েছিল। গোটা দুনিয়া স্বীকার করেছিল, জে সি বোসই ঠিক। আর আজ, প্রায় শতবর্ষ পর কলকাতার পাঁচ অধ্যাপক সেটাই আবার প্রমাণ করলেন। আচার্যের প্রতি এ সত্যিই এক অনন্য শ্রদ্ধা, সম্মান।