অসুস্থ লাপিয়ের, বিপদে বাংলার বহু সংস্থা


এ কলকাতার মধ্যে আছে আর একটা কলকাতা, যেখানে প্রবল দারিদ্রের মাঝেও ঝিকিয়ে ওঠে অফুরান প্রাণশক্তি, বিশ্বদরবারে সেটা তিনিই চিনিয়েছিলেন। ফলে বন্‌ধ, মিছিল, গরিবি, যানজটের শহরের মাথায় উঠেছে আনন্দনগরীর তাজ। কিন্তু, 'সিটি অফ জয়'-এর স্রষ্টা দোমিনিক লাপিয়ের যে গত কয়েক বছর ধরেই গুরুতর অসুস্থ, সে কথা কি মনে রেখেছে কলকাতা? 

ছ'বছর আগে মারাত্মক একটি দুর্ঘটনার পরে মাস আটেকের বেশি কোমায় ছিলেন তিনি। তারপর ধীরে সাড় ফিরলেও এখন চলচ্ছক্তিহীন, থাকেন দক্ষিণ ফ্রান্সে প্রবীণ এবং প্রতিবন্ধী মানুষদের একটি হোমে। পঁচাশি-ঊর্ধ্ব 'পদ্মভূষণ' লেখক লিখতে বা পড়তে পারেন না, বাক্‌শক্তিও নেই বললেই চলে। কলকাতার সংস্কৃতি জগত সে বিষয়ে উদাসীন থাকলেও তাঁর অসুস্থতায় বিপাকে এই রাজ্যের অগণিত মানুষ। কারণ, লাপিয়েরের অর্থ সাহায্যেই পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ওঠে একাধিক সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান, যাতে উপকৃত রাজ্যের কয়েক হাজার অনাথ ও প্রতিবন্ধী শিশু, বয়স্ক মহিলা ও পুরুষ। তা ছাড়া, লাপিয়েরের বই বিক্রির টাকায় সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় নদীতে ভাসমান চিকিৎসা পরিষেবাও চালু হয়। কিন্তু, অর্থসঙ্কটের কারণেই 'ফাউন্ডেশন অফ দ্য সিটি অফ জয়' এবং লাপিয়েরের স্ত্রী গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দেন, ফলে বেকায়দায় পড়ে একাধিক বেসরকারি সংস্থা। 

এদেরই অন্যতম সাদার্ন হেলথ ইমপ্রুভমেন্ট সমিতি, যারা প্রত্যন্ত সুন্দরবন এলাকায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলিতে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেয়। সমিতির সম্পাদক এম এ ওহাবের দাবি, সুন্দরবন এলাকার প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর তাঁদের ভাসমান চিকিৎসা কেন্দ্রে এসে চিকিৎসা করান। দাতব্য চিকিৎসার পাশাপাশি বিনামূল্যে ওষুধও দেওয়া হয়। আছে মোবাইল ক্লিনিক, যক্ষ্মার চিকিৎসা, মূক ও বধির স্কুল, ছাত্রদের হস্টেল, ভাঙড়ে চক্ষু হাসপাতাল। বিপুল খরচের সিংহভাগটাই আসত লাপিয়েরের কাছ থেকে। কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বর থেকে টাকা আসা বন্ধ। ওহাবের কথায়, 'রোগী দেখার কাজটা হয়তো এখনও চলছে, কিন্তু বিনা পয়সায় কাউকে ওষুধ দিতে পারছি না।'লাপিয়েরের অর্থেই হাওড়ার মাধবপুরে গড়ে উঠেছে ইন্টার রিলিজিয়াস সেন্টার অফ ডেভলপমেন্ট সংক্ষেপে আইকড। তাদের অধীনে রয়েছে একটি অনাথ আশ্রম এবং বৃদ্ধাশ্রম। সংস্থার উদ্যোগেই ইটভাটায় কর্মরত আদিবাসী শিশুদের জন্য গড়ে উঠেছে অবৈতনিক স্কুল। সেখানে প্রায় ২০০ জনের মতো পড়ুয়া।

টেলারিং স্কুলে মোট ২০০ জন দুঃস্থ মহিলা নিখরচায় টেলারিংয়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে। সংস্থার সম্পাদিকা মমতা ঘোষ বলেন, 'আমাদের আশ্রমে সব মিলিয়ে প্রায় ৭২ জন আবাসিক। তাঁদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাঁদের নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছি। একই রকম সমস্যায় উলুবেড়িয়ার বানিতবলার আশা ভবনের প্রায় একশো জন প্রতিবন্ধী আবাসিক। দোমিনিকের স্ত্রী ই-মেল মারফত জানিয়ে দিয়েছেন, আর টাকা পাঠাতে পারবেন না।'হাওড়ার পিলখানা বস্তিতে বসেই 'সিটি অফ জয়' লিখেছিলেন যে ক্ষুরধার সাংবাদিক ও লেখক, তিনি এখন কার্যত বোধশক্তির বাইরে। তাঁর এই অসহায় অবস্থা যে সুদূর পশ্চিমবঙ্গে অজস্র মানুষের গভীর নিরানন্দের কারণ হয়ে উঠেছে, সে তথ্য তাঁকে স্পর্শ করতে পারেন না। হয়তো পারবেও না। কোনও দিন না।