৫ কোটির জমি হল ৫৩ কোটির


কাঠা প্রতি যে জমির দাম ছিল ২৭ হাজার টাকা, তারই 'চরিত্র' বদল করে দাম হয়ে গেল ২ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা! যা নিয়ে তোলপাড় কলকাতা পুরসভা।

কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, ধাপার বিকল্প হিসেবে নতুন একটি ভাগাড় তৈরির জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনার রসপুঞ্জে প্রায় ৩৫ একর জমি চিহ্নিত করেছিলেন পুরকর্তারা। জায়গাটি এক লপ্তে মেলেনি। তাতে রয়েছে ছোট ছোট অনেক জমি। গত এপ্রিলে সেই সমস্ত জমির তালিকা পাঠানো হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের কাছে। জুলাইয়ে জেলা প্রশাসনের তরফে জানানো হয়, কাঠা প্রতি ২৭ হাজার টাকার মতো লাগবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে হঠাৎই পুরসভার পাঠানো জমির সেই তালিকায় 'সেমি কমার্শিয়াল' শব্দ‌টি হাতে লিখে জুড়ে দেওয়া হয়। তাতেই জমির মূল্য বেড়ে হয় কাঠা প্রতি প্রায় ২ লক্ষ ৫২ হাজার টাকা! ফলে প্রথমে যে জমির দাম ধরা হয়েছিল ৫ কোটি ৫১ লক্ষ টাকা, সেমি-কমার্শিয়াল শব্দটি জুড়ে দেওয়ায় তার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৫৩ কোটি ৫ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, ১০ গুণ বেশি!

কেন পুরসভার দেওয়া তালিকায় 'সেমি-কমার্শিয়াল' শব্দটি যোগ করা হল, তা নিয়েই তোলপাড় পুর মহল। পুর মহলে প্রশ্ন উঠেছে, 'বিশেষ' কারও জমির দাম বাড়িয়ে দিতেই কি ওই শব্দটি পরে ঢোকানো হয়েছে? প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের গোচরেও বিষয়টি আনা হয়েছিল। পুর প্রশাসন সূত্রে বলা হয়েছে, শোভন এ নিয়ে ততটা সক্রিয় হননি। সম্প্রতি বর্তমান মেয়র ফিরহাদ হাকিমের নজরেও বিষয়টি আনা হয়। সূত্রের খবর, জেলা প্রশাসনকে মেয়র জানিয়ে দিয়েছেন, জঞ্জাল ফেলার জমি সেমি-কমার্শিয়াল করা যাবে না। মেয়রের আশ্বাস পেয়ে আপাতত কিছুটা স্বস্তিতে সংশ্লিষ্ট পুর অফিসারেরা। এক আধিকারিকের কথায়, ''সরকারের ভাঁড়ার থেকে অতিরিক্ত ৪৮ কোটি টাকা অপচয় হয়তো রোখা যাবে।'' 

দীর্ঘকাল ধরেই কলকাতা শহরের জঞ্জাল ফেলার প্রধান জায়গা হল ধাপার মাঠ। দৈনিক সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন জঞ্জাল ফেলা হয় ধাপায়। ২০০১ সালে পুরসভা জানিয়েছিল, ধাপার মাঠ পূর্ণ। তাই জঞ্জাল ফেলার নতুন জায়গা দেখতে হবে। দেরিতে হলেও গত এপ্রিলে পুর প্রশাসন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর ব্লকের রসপুঞ্জ মৌজায় প্রায় সাড়ে ৩৫ একর জমি চিহ্নিত করে। সে সময়ে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও জানিয়েছিলেন, ধাপার বিকল্প জমি দেখা হচ্ছে রসপুঞ্জে। গত ৯ এপ্রিল সেই সমস্ত জমির দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, পরিমাণ দিয়ে পুর অফিসারের সই করা একটি তালিকা পাঠানো হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের কাছে।

জুলাইয়ে জেলা প্রশাসন পুরসভাকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়, ওই জমির মূল্য ৫ কোটি ৫১ লক্ষ টাকা। এর পরে সেপ্টেম্বর মাসে পুর প্রশাসনের নজরে আসে, তাদের দেওয়া তালিকার উপরে কলম দিয়ে লেখা হয়েছে 'সেমি-কমার্শিয়াল'। সংশ্লিষ্ট ব্লকের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর থেকে জানানো হয়, যে হেতু জঞ্জাল ফেলার জায়গা কৃষিজমি নয়, তাই তা সেমি-কমার্শিয়াল করা যেতে পারে। জমির চরিত্র সেমি-কমার্শিয়াল হয়ে যায় তার পর থেকেই। বিষয়টি জানতে পেরেই কলকাতা পুরসভার জমি জরিপ দফতর তা পুরকর্তাদের নজরে আনে।

পুরসভার এক আধিকারিক জানান, এর পরেই রাজ্যের রেজিস্ট্রেশন দফতরের কাছে ওই জমির মূল্য জানতে চাওয়া হয়। সেই সঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনকেও চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয়, তাদের দেওয়া তালিকায় সেমি-কমার্শিয়াল শব্দটা ঢোকানো হল কেন? এবং তা যে কলকাতা পুরসভার পক্ষ থেকে করা হয়নি, তা-ও জানানো হয়। সম্প্রতি কলকাতার মেয়র পদে বসতেই বিষয়টি জানানো হয় ফিরহাদ হাকিমকে। তার পরেই পুরভবনে ডেকে পাঠানো হয় আইজি, রেজিস্ট্রেশনকে। গত ৭ ডিসেম্বর আইজি-র দফতর থেকে সরকারি ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, যে কাজে ওই জমি ব্যবহার করা হবে বলা হয়েছে, তার জন্য বাজারমূল্য ৫ কোটি ৫১ লক্ষ টাকা হওয়া উচিত। তবে সেমি-কমার্শিয়াল হলে তার দর ৫৩ কোটি ৫ লক্ষ টাকা হবে। অর্থাৎ, সেমি-কমার্শিয়াল করা হলে সরকারের ঘর থেকে বাড়তি ৫০ কোটি টাকা বেরিয়ে যাবে। এ বিষয়ে মেয়র বলেন, ''জঞ্জাল ফেলার জমি সেমি-কমার্শিয়াল হবে না।''