রাজ্য থেকেও দুবাই ঘুরে পাক জঙ্গিদের কাছে যেত টাকা, পিছনে আইএসআই


কলকাতা: শুধু এদেশ বা রাজ্যের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে পাকিস্তান থেকে টাকা ঢুকেছে এমনটা নয়, রাজ্য থেকেও দুবাই ঘুরে পাকিস্তানি জঙ্গিদের কাছে যেত অর্থ। যার নেপথ্যে রয়েছে সেদেশের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। এমনকী কেবলমাত্র এরাজ্যই নয়, দিল্লি সহ অন্যান্য রাজ্যেও এই চক্রের হদিশ পেয়েছে পুলিস। হাওড়ায় ধৃতদের জেরা করে পুলিস এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানতে পেরেছে।
লাগাতার আন্তর্জাতিক চাপে ইদানীং পাক জঙ্গিদের হাতে বিদেশি তহবিলের উৎসে কিছুটা টান পড়েছে। সাধারণ মানুষকে হুমকি-ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করার পাশাপাশি প্রতারণার ফাঁদে ফেলে জঙ্গি কার্যকলাপের রসদ জোগাড়ে নেমেছে তারা। জঙ্গিরা কীভাবে চালাত এই নেটওয়ার্ক? পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, বিভিন্ন কল সেন্টার থেকে একাধিক ব্যক্তিকে ফোন করে আদায় করা প্রতারণার মোটা টাকা দুবাই ঘুরে চলে যেত পাকিস্তানে। যেমন— হাওড়া, বাঁকুড়া, উত্তর ২৪ পরগনা ও জলপাইগুড়ি জেলায় সম্প্রতি বেশ কিছু কল সেন্টার থেকে 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি'র নাম ভাঙিয়ে বলা হয়েছে, 'আপনি ১০ কোটি টাকার লটারি জিতেছেন। এর জন্য আপনাকে ১০ লক্ষ টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট রাখতে হবে।' মোটা টাকার প্রলোভনে অনেকে সেই টাকা নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে ফেলেও দিয়েছেন। তারপরই তিনি বুঝতে পারেন যে, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। তখন তিনি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
প্রতারিতদের জমা করা টাকা দ্রুত তোলার পর তা লোকাল এজেন্ট মারফত হাতবদল হয়ে পৌঁছে যেত দিল্লির এক ব্যবসায়ীর কাছে। পুলিস জানিয়েছে, সেই ব্যক্তির আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা। এই ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ ভারতীয় টাকার একটি অংশ দিয়ে গাড়ির যন্ত্রাংশ কিনে তা দুবাই হয়ে পাকিস্তানে পৌঁছে দিত ফারুকের কাছে। ফারুক সেই যন্ত্রাংশ বিক্রি করে যে অর্থ পেত, তা তুলে দিত জঙ্গি সংগঠনগুলির হাতে। এছাড়াও দিল্লি থেকে পাঠানো বাকি নগদ টাকা দুবাই হয়ে পৌঁছে যেত ফারুকের কাছে। দুবাইয়ে মূলত ওই টাকার বদলে ডলার কেনা হতো। এই অর্থ দিয়েই মাদক ও পাক জঙ্গিদের জন্য অস্ত্র কেনা হয়েছে বলে পুলিসের কাছে খবর। যে মাদক ও অস্ত্র আবার পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ঘুরপথে এদেশে ঢুকছে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। ফারুক ছাড়াও আরও পাঁচ পাক নাগরিকের নাম পাওয়া গিয়েছে, যাদের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগ রয়েছে বলে দাবি পুলিসের। ধৃতদের মোবাইল কল, হোয়াটসঅ্যাপের সূত্র ধরেই এই তথ্য জানা গিয়েছে।

যে কল সেন্টারগুলি এই দেশে প্রতারণা করত ও যাদের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হতো, তাদের কাছে পাকিস্তান থেকে আসত শুধু কমিশনের টাকা। প্রতি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ টাকা তারা কমিশন হিসেবে পেত। ধৃতরা মূলত টাকার লোভেই বিভিন্ন জনের নামে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলত। এই কাজে গরিব-বেকারদের নিয়োগ করত লিঙ্কম্যানরা। হাওড়ায় চেক জালিয়াতির তদন্তে নেমে মূল চক্রীর নামও পুলিস জানতে পেরেছে। হোয়াটসঅ্যাপ কল ও স্কাইপিতে তারা এদেশের এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলত। ফলে তাদের কল মনিটর করা এতদিন সম্ভব হয়নি। পুলিস জানতে পেরেছে, শুধু এই রাজ্যই নয়, গোটা দেশেই এই চক্রের জাল ছড়িয়ে আছে। সেই কারণে মঙ্গলবার সকালে হাওড়া সিটি পুলিসের তিনটি দল দিল্লি সহ ভিনরাজ্যে তল্লাশি অভিযানে বেরিয়েছে।

সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত গোলাবাড়ি থানার আইসি তথাগত পাণ্ডে সহ সিটি পুলিসের পদস্থ কর্তারা ধৃতদের দফায় দফায় জেরা করেন। জানা গিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে ধৃতদের কাছে পাকিস্তান থেকে নানা রকম নির্দেশ আসত। মঙ্গলবার সকালে হাওড়ার পুলিস কমিশনার তন্ময় রায়চৌধুরী ও পুলিসের পদস্থ কর্তারা ফের গোলাবাড়ি থানায় যান। তাঁরাও ধৃতদের জেরা করেন। এরপর পুলিস কয়েকটি ব্যাঙ্কের কাছে স্টেটমেন্ট ও অন্যান্য তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে।

পুলিস কমিশনার এদিন বলেন, হাওড়া ও কলকাতার কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি চলছে। এই ঘটনার পিছনে অনেক বড় চক্র কাজ করছে। আমরা গোটা ঘটনা খতিয়ে দেখছি। পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃতদের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট, ফোনের কললিস্ট, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, স্কাইপি নেটওয়ার্ক পরীক্ষা করে দেখার কাজ শুরু হয়েছে। এর জন্য তথ্যপ্রযুক্তি ও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। পুলিস কর্তারা বলেছেন, সব তথ্য হাতে আসতে কিছু সময় লাগবে। ইতিমধ্যেই ধৃতদের জেরা করে বাকি তথ্য জানার চেষ্টা হচ্ছে। ভিনরাজ্যে যে দল গিয়েছে, তাদের রিপোর্টের উপরও এই কেসের অনেক কিছু নির্ভর করছে।
পুলিস সূত্রে জানা গিয়েছে, মঙ্গলবার রাত ও বুধবার সকাল থেকে ফের তাদের জেরা করা হবে। এই রাজ্যে কোথায় কোথায় তাদের এজেন্ট ছড়িয়ে আছে, সে বিষয়ে খেঁাজখবর নিচ্ছে পুলিস। কয়েকটি সূত্র পেলেও সে বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ কর্তারা।