মনে হচ্ছিল আর বেঁচে ফিরব না, সেনাবাহিনী না থাকলে কী হত!

গ্যাংটকের ফিরতি পথে দাঁড়িয়ে রয়েছে একের পর এক গাড়ি। ইনসেটে লেখক।

প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি, এখনও সেই ভয়টা কাটেনি!শুধু ভাবছি, সেনাবাহিনী না থাকলে কী হত!
শুক্রবার সকাল ৮টা নাগাদ আমরা ৬ জন একটা এসইউভিতে করে গ্যাংটক থেকে বেরিয়েছিলাম। যাওয়ার কথা ছিল না-থুলা। কিন্তু ছাঙ্গু লেক পৌঁছনোর আগেই আবহাওয়াটা কেমন পাল্টাতে শুরু করল। ঝির ঝির করে বরফের গুঁড়ো পড়ছে। কিন্তু, সেটাই যে পরে অমন ভয়ানক চেহারা নেবে ভাবতে পারিনি!

ছাঙ্গুতে নেমে আধ ঘণ্টা মতো ছিলাম। শীতপোশাক ভিজে যাচ্ছে ঝুরো বরফে। বরফ পড়ার মাত্রাটাও যেন আস্তে আস্তে বাড়ছিল। বেলা তখন ১২টা হবে, হুড়মুড়িয়ে বরফ পড়া শুরু হল। সঙ্গে সঙ্গে প্রায় দৌড়েই গাড়িতে চলে এলাম সকলে। চালক দাজু বললেন, এই পরিস্থিতিতে না-থুলা যাওয়া ঠিক হবে না। গ্যাংটক ফিরে যাওয়াই ভাল। আমরা আর আপত্তি জানালাম না।

কিন্তু, গাড়ি চলতে শুরু করতেই পিছনের চাকাটা রাস্তা থেকে প্রায় ফুট দুয়েক পিছলে গেল। খাদের ঠিক কিনারায় গিয়ে আটকে গেল শেষমেষ। উফস্‌! সকলে তখন কাঁপছি। এক মুহূর্তে কী ঘটে যাচ্ছিল! চালক দাজু জানালেন, এ অবস্থায় গাড়ি চালানো আর যাবে না। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে।

আমাদের সামনে-পিছনে সব গাড়ি থেকেই সকলে নেমে পড়ছে দেখলাম। কিন্তু নেমেই বা কী করব! হাঁটতে হাঁটতেই এগোলাম একটু। একটা দলের সঙ্গে পরিচয় হল। ওরা নিয়মিত অ্যাডভেঞ্চার ট্রেক করে। বলল, হেঁটেই নামতে হবে। কিন্তু, এখান থেকে গ্যাংটক অবধি হাঁটা সম্ভব নাকি! এর মধ্যেই কয়েক জন সেনাকর্মীকে দেখলাম। সকলেই এগিয়ে গেল তাঁদের দিকে। জানা গেল, ওঁরা এই খারাপ আবহাওয়া দেখেই পর্যটকদের সাহায্য করতে এসেছেন।

১৭ মাইল সেনা ছাউনিতে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে পর্যটকদের। ছবি সৌজন্য: ভারতীয় সেনাবাহিনী।

ওঁদের নির্দেশ মতো এ বার আমরা হাঁটা শুরু করলাম। গন্তব্য ১৭ মাইল ক্যাম্প। তখন দুপুর দেড়টা বাজে। প্রচণ্ড বরফ পড়ছে। তার মধ্যেই সকলে সার দিয়ে হাঁটছে। গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি, বারে বারেই পা পিছলে যাচ্ছে। ১৭ মাইল কত দূর জানি না। মোবাইলে কোনও নেটওয়ার্ক নেই। শুধু সামনের লোককে ফলো করে এগিয়ে যাচ্ছি।

ঘড়ি না দেখলে বিকেল বা সন্ধে বোঝার উপায় নেই। সন্ধে ৬টা নাগাদ এসে পৌঁছলাম একটা ক্যাম্পে। পৌঁছতেই সেনাকর্মীদের অব্যর্থনা দেখে চমকে গেলাম। শরীর ঠিক আছে কি না, খিদে পেয়েছে কি না, ঠান্ডা লাগছে কি না— সব কিছু খতিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। অতটা হেঁটে সকলেই এতটু বসতে চাইছেন। দেখলাম, নিজেদের থাকার জায়গাই হাট করে খুলে দিয়েছেন ওঁরা। সঙ্গে সঙ্গে সকলকে দেওয়া হল গরম চা। বাচ্চাদের বেবি ফুডের ব্যবস্থাও রয়েছে। বয়স্কদের জন্য গরম দুধও দিলেন ওঁরা। একটু ধাতস্থ হয়ে দেখলাম, গোটা ক্যাম্পটা ভরে গিয়েছে পর্যটকে। আরও লোকজন আসছেন। সকলকেই উদ্ধার করার চেষ্টা করছেন সেনাকর্মীরা।

রাতে আমাদের খেতে দেওয়া হল লুচি, ছোলার ডাল। রাতে শুতে গেলাম ওদেরই ক্যাম্প-খাটে। সেনাকর্মীরা দিয়েছিলেন গরম কম্বল-জ্যাকেট। বারে বারেই জিজ্ঞেস করছিলেন ওঁরা, আমাদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে কি না? ওঁদের কাউকেই রাতে শুতে দেখিনি। রাত তখন ১২টা হবে, মোবাইলে হঠাৎ করেই একটু নেটওয়ার্ক এল। বাইরে এসে দেখি, গোটা ক্যাম্পটা ভরেগিয়েছে পর্যটকে। এক সেনাকর্মীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, তখনও পর্যন্ত তিন হাজার পর্যটককে উদ্ধার করেছেন ওরা। ১৭ মাইলের পাশাপাশি তাঁদের ১৩ মাইল ক্যাম্পে রাখা হয়েছে।

সকালে ওঠার পর সকলকে আবার খাবার দেওয়া হল। দেওয়া হল চা-বিস্কুট। সকলের শরীর সুস্থ আছে কি না, তা-ও জিজ্ঞেস করলেন ওঁরা। গ্যাংটক থেকে আমাদের ট্যুর অপারেটর সংস্থার এক কর্মী এসেছেন। আবহাওয়া অনেকটাই পরিষ্কার। কিন্তু, রাস্তায় বরফ জমে রয়েছে। সেনাকর্মীরা সেই বরফ পরিষ্কার করে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। দুপুরের খাবারদাবার তৈরি হচ্ছে ক্যাম্পে। আর সবটাই করছেন ওই সেনাকর্মীরাই।

এই রকম পরিস্থিতিতে এত কষ্ট করে উদ্ধার করার পর, নিজেদের সবটা ছেড়ে দিয়ে এতটা যত্ন যাঁরা করলেন, সেই সেনাকর্মীদের আন্তরিক সাহায্য ছাড়া এ যাত্রা হয়তো বেঁচেই ফিরতে পারতাম না। আপাতত গ্যাংটক রওনা দেওয়ার অপেক্ষায় আছি।

(লেখক হুগলির ত্রিবেণী থেকে সিকিম ঘুরতে গিয়েছেন।)