বিরল রোগাক্রান্ত শিশুর ওষুধের খরচ দেয় না রাজ্য, পুজোয় ক্লাবগুলো পায় ২৮ কোটি টাকা!


স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি-তে আক্রান্ত দেবস্মিতা ঘোষ।

কয়েক মাস আগে স্বাস্থ্য ভবনে যখন চিকিৎসার খরচ চেয়ে আবেদন জানানো হয়েছিল, আট বছরের দেবস্মিতা ঘোষের মেরুদণ্ড বেঁকে ছিল ২৫ শতাংশ। দিন কয়েক আগে সেই আবেদনের উত্তর যখন এল, মেরুদণ্ড ৬০ শতাংশেরও বেশি বেঁকে গিয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা সাফ জানিয়েছেন, যে ওষুধের জন্য আবেদন করা হয়েছে, তা 'অনৈতিক ধরনের চড়া মূল্যের' (আনএথিকালি হাই) এবং তার সাফল্যের হারও উল্লেখযোগ্য নয়। তাই স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষজ্ঞ কমিটি এই আবেদন গ্রাহ্য করতে পারছে না।
চিকিৎসকদের একাংশেরই প্রশ্ন, ওষুধের দামকে অস্বাভাবিক বলা যেতে পারে, কিন্তু 'অনৈতিক'? দেবস্মিতার মতো স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি (এসএমএ) আক্রান্ত শিশুদের পরিবারের আবেদনকে নাকচ করে যে চিঠি সরকারি তরফে দেওয়া হয়েছে, তাতে সই রয়েছে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের। তিনি বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁর দফতরের আধিকারিকেরা জানান, একটি জীবনদায়ী ওষুধের দাম কখনওই এত বেশি হওয়া উচিত নয়। সে কারণেই 'অনৈতিক' বলা হয়েছে। 
এখনও পর্যন্ত এ রাজ্যে ১০০ জন এসএমএ আক্রান্ত শিশুর সন্ধান মিলেছে। তাদের বাবা-মায়ের প্রশ্ন, ''স্বাস্থ্য দফতরের চিঠিতে লেখা হয়েছে যে, ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা হয়নি। কিন্তু আমাদের সন্তানেরা কী ভাবে দীর্ঘ সময় পাবে? ওরা তো বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।''

জিনঘটিত রোগ এসএমএ-এর ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে ওই একটি ওষুধ রয়েছে, বছরে যার খরচ প্রায় ছ'কোটি টাকা। আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) ওষুধটিকে ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু বিপুল দামের জন্য তা এখনও অধরা অধিকাংশের কাছেই।

কিছু দিন আগে দিল্লি সরকারের কাছে ওই রোগের চিকিৎসার খরচ চেয়ে দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন এক দম্পতি। হাইকোর্ট দিল্লি সরকারকে খরচ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। বিষয়টি আপাতত কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বিচারাধীন। কারণ, বিরল রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত খরচের ৪০ শতাংশ রাজ্যের, ৬০ শতাংশ কেন্দ্রের দেওয়ার কথা। এই জন্য ১০০ কোটি টাকার তহবিলও রয়েছে। প্রশ্ন হল, এখানে কেন রাজ্য সরকার গোড়াতেই 'না' বলে দিচ্ছে? এর আগে এসএমএ আক্রান্ত ১৩ বছরের ঋদ্ধিমা পালের অস্ত্রোপচারের খরচ দেওয়ার আর্জিও সরকার নাকচ করেছিল।

রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদেরই একাংশ অবশ্য বলছেন, যেখানে ক্যানসার রোগীদের জন্য ১০০ কোটি টাকার প্রকল্প কার্যত অকেজো হয়ে পড়ে থাকে, সেখানে জীবনদায়ী ওষুধের জন্য টাকা বরাদ্দ করতে সরকার কেন রাজি হয় না? এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ''১০০ কোটি টাকার সুদ কত হয়? ভেবে দেখা হোক। দুর্গাপুজোর জন্য ক্লাবগুলিকে ২৮ কোটি টাকা সাহায্য করতে দু'বার ভাবতে হয় না, অথচ কয়েকটি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে আপত্তি?'' আধিকারিকদের অন্য অংশের অবশ্য দাবি, ওই ওষুধের সাফল্যের হার সম্পর্কে এখনও খুব বেশি জানা যায়নি। ওষুধের কিছু খারাপ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।

দেবস্মিতার মা মৌমিতার কথায়, ''বিরল রোগের ওষুধ বেশি ব্যবহার না হওয়াই স্বাভাবিক। আর ওষুধ না পেলে বাচ্চারা শেষ হয়ে যাবে। তখন কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার অবকাশ থাকবে না। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে ভরসা আছে। উনি নিশ্চয় আমাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়াবেন।'' শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষও বলেছেন, ''ওষুধ দেওয়ার পর দিনই বাচ্চাগুলো লাফাতে শুরু করবে, তা নয়। কিন্তু চেষ্টা তো করা দরকার। ওষুধ না দিয়ে সাফল্যের হার সম্পর্কে কী ভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?  চিকিৎসা না হওয়ায় বাচ্চাগুলো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটাও তো দেখা যায় না।''

সর্বভারতীয় সংগঠন 'অর্গানাইজেশন ফর রেয়ার ডিজিজেস ইন্ডিয়া'-এর অধিকর্তা প্রসন্ন সিরোলের কথায়, ''বিরল রোগের ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে। তার অর্থ এই নয় যে তার ব্যবহার হবে না। আর কোনও ওষুধেই ম্যাজিকের মতো রোগ সারে না। রোগের বাড়বৃদ্ধি এ ক্ষেত্রে হয়তো ঠেকানো সম্ভব। একটি শিশু কেন সেই অধিকার পাবে না?''