মুড়িমুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক রুখতে রাজ্য তৈরি করল গাইডলাইন


কলকাতা: মুড়িমুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া ঠেকাতে রাজ্য তৈরি করে ফেলল গাইডলাইন। চিকিৎসাশাস্ত্রের ২০টির বেশি বিভাগের সমস্ত পরিচিত অসুখবিসুখ মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে এটি। লক্ষ রাখা হয়েছে বিরল অসুখবিসুখের প্রতিও। সঠিক রোগে রোগীর সহনশীলতা মাথায় রেখে সঠিক ডোজে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারকে প্রাধান্য দিয়েই তৈরি হয়েছে এই গাইডলাইন। কম দামের মধ্যেও সুনির্দিষ্ট রোগে অপ্রচলিত কিন্তু কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের কথাও বলা রয়েছে এখানে। কোন রোগে, কখন অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার প্রয়োজন নেই— সেকথাও সুস্পষ্টভাবে বলা রয়েছে।

যদিও এ ধরনের গাইডলাইনের কথা শুনে বহু নামকরা ক্লিনিশিয়ানই বলছেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স রুখতে গাইডলাইনের প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। কিন্তু, তা যেন চিকিৎসকের স্বাধিকার ক্ষুণ্ণ না করে। সোমবার বিশিষ্ট ফিজিশিয়ান ডাঃ সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, গাইডলাইন ভালো। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, এটা চিকিৎসাশাস্ত্র। দুয়ে দুয়ে সবসময় চার হয় না। কেস অনুযায়ী, পরিস্থিতি অনুযায়ী ডাক্তারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। পরিবর্তনও করতে হয়। তাই খোলা মনে গাইডলাইন ব্যবহারের ক্ষমতা দেওয়া উচিত। কখনও যেন মনে না হয়, চাপিয়ে দেওয়া হল।

২০১৫ সালে মলয় দে স্বাস্থ্যসচিব থাকার সময় রাজ্যের সরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার আরও বিজ্ঞানসম্মত করতে এই গাইডলাইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। দায়িত্ব ন্যস্ত হয় রাজ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা নামকরা ফার্মাকোলজিস্ট ডাঃ কৃষ্ণাংশু রায়ের উপর। রাজ্য, ভিন রাজ্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নামকরা চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে অবশেষে তৈরি হয়েছে এটি। বর্তমানে এটি ছাপতে গিয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তাদের হাতে চলে আসার কথা নতুন বছরের গোড়ায়। তখন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ মিলিয়ে কয়েক হাজার সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে এই গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসক এবং নার্সদের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে— এমনটাই জানা গিয়েছে দপ্তরের একাধিক শীর্ষ সূত্রে। তাঁদের দাবি, রাজ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ইতিহাসে সরকারের তৈরি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার এমন সুপরিকল্পিত গাইডলাইন আগে ছিল না। হাসপাতালগুলির সুবিধার্থে ৬০-৬৫ পাতার গাইডলাইনটি পুস্তকাকারে প্রত্যেক সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সুপারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তিনি প্রয়োজন বুঝে তা সরবরাহ করবেন চিকিৎসকদের হাতে। জানুয়ারির গোড়ায় বইটির প্রথম কপি মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেবেন ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা। কৃষ্ণাংশুবাবু বলেন, অন্য কোনও রাজ্যের এ ধরনের সুপরিকল্পিত অ্যান্টিবায়োটিক নীতি আছে কি না জানা নেই। আপনারা গাইডলাইন বলতে পারেন, আমি বলব রেকমেন্ডেশন বা সুপারিশ। সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছি। কতটা মানা হবে, কতটা হবে না— সেটা রাজ্যের বিষয়। 
দপ্তর সূত্রের খবর, এটি তৈরির কাজ মোটেই সহজ ছিল না। প্রথমেই জানা জরুরি ছিল, কোন সরকারি হাসপাতালে কী রোগে কোন অ্যান্টিবায়োটিক বেশি বেশি দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ ইনস্টিটিউট এজন্য একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি এক্সপার্ট কমিটি গঠন করে। শুধু তাই নয়, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ছ'টি হাসপাতালে প্রেসক্রিপশন অডিট শুরু হয়। সেখান থেকে তথ্য পেয়ে প্রস্তুত হয় খসড়া তালিকা। তা পাঠানো হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিল্লির এক খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞকে। তাঁর উপস্থিতিতে এক্সপার্ট কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত ঝাড়াইবাছাইয়ের কাজ শুরু হয়। এরপর গাইডলাইনটি পাঠানো হয় তিন নামকরা রিভিউয়ারের কাছে তাঁদের চূড়ান্ত মতামত জানতে। সেসব আসার পর গাইডলাইনটি ছাপতে গিয়েছে। বাস্তবায়িত হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, গাইডলাইন তৈরির সময় যেসব বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে সরকারি ছাড়াও প্রাইভেট হাসপাতালের নামজাদা ডাক্তাররাও আছেন। কৃষ্ণাংশুবাবু জানান, তালিকাটি দপ্তরের ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলিও যদি প্রয়োগ করতে চায়, স্বাগত।