‘ফাঁসির সাজা দিলেও কিছু যায়-আসে না’, বিচার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ লস্কর জঙ্গির


হায়দরাবাদে মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণ, লস্করের হয়ে দেশে নাশকতা ছড়ানোর ষড়যন্ত্র, আরও তিন লস্কর জঙ্গি নিয়ে অনুপ্রবেশ করে সেনা ছাউনিতে হামলা চালানোর ছক। এমনই একাধিক দেশদ্রোহিতার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার বনগাঁ আদালতে সাজার শুনানি হল সেই লস্কর জঙ্গি শেখ সমীরের। মৃত্যুদণ্ড চাইলেন সরকারি আইনজীবী। কিন্তু নির্বিকার রইল জঙ্গি শেখ নইম ওরফে শেখ সমীর৷ বিচারকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা তো দূর, বরং ভরা এজলাসে দাঁড়িয়ে বিচার প্রক্রিয়াকেই সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল সে। বিচারকে সে বলল, "আমি জানি, আপনি আমাকে ফাঁসির সাজা দেবেন, আমার কিছু যায়-আসে না। আমি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছি।"

কেবলমাত্র ২০১৬-য় উরির সেনা ছাউনিতে হামলাই নয়, ২০০৭-এও কাশ্মীরের সেনা ছাউনিতে হামলার ছক কষেছিল লস্কর-ই-তইবা। সে সময় এক সুইসাইড বম্বার ও দুই জঙ্গিকে বনগাঁ সীমান্তের চোরাপথ দিয়ে দেশে ঢুকিয়েছিল এই সমীর। আরডিএক্স দিয়ে সেনা জওয়ানদের একটি ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার ছক কষেছিল জঙ্গিরা। তবে হামলা চালানোর আগেই পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে তাদের পাকড়াও করেছিল বিএসএফ। মামলাটির তদন্তভার নেয় সিআইডি। তাদের জেরা করে কলকাতায় লস্করের গোপন ডেরার সন্ধান মেলে। উদ্ধার হয় বিস্ফোরক। দেশদ্রোহিতার অপরাধে ওই লস্কর টিম-এর তিন জঙ্গিকে ফাঁসির সাজা দেয় আদালত। কিন্তু সাজা দেওয়ার আগেই পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল জঙ্গিরা এবং সেইই জঙ্গি দলের মূলপাণ্ডা হল শেখ আবদুল্লাহ নইম ওরফে শেখ সমীর। বছর তিনেক ফেরার থাকার পর ফের পুলিশের জালে ধরা পড়ে সে। মঙ্গলবার তাকে সমীরকে দোষী সাব্যস্ত করে বনগাঁ আদালত। সমীরের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছিলেন সরকারী আইনজীবী সমীর দাস৷ তিনি বলেন, "সরকারের তরফ থেকে সমীরের মৃত্যেুদণ্ড সাজার আবেদন করা হয়েছে। বিচারক সমীরকে তার মন্তব্য জানাতে বলেন। কিন্তু কোনও ক্ষমা প্রার্থনা করেনি সে। শনিবার তাকে সাজা শোনাতে পারেন বিচারক।"

ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই কুখ্যাত লস্কর জঙ্গি শুধু এই মামলায় নয়, দেশের আরও দু'টি বড় নাশকতার মামলায় মোস্ট ওয়াটেন্ড৷ সিআইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের বাসিন্দা শেখ সমীর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিল৷ ২০০৭ সালে পেট্রাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে তিন লস্কর জঙ্গি মহম্মদ ইউনুস (৬০), আবদুল্লাহ (৩৪), মুজফ্ফর আহমেদ রাঠের (৩২) সঙ্গে সমীরকেও গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারির পর বেঙ্গালুরুতে এই চার জঙ্গির ব্রেন ম্যাপিং, পলিগ্রাফ ও নারকো অ্যানালাইসিস টেস্ট করা হয়৷ সেখানে তদন্তকারীদের কাছে সব অপরাধ স্বীকার করে সমীর৷ সূত্রের খবর, সমীর তদন্তকারীদের কাছে স্বীকার করে লস্কর-ই তৈবার কম্যান্ডার ছিল সে। হায়দরাবাদে মক্কা মসজিদ বিস্ফোরণের ছক সে নিজে সজিয়েছিল। লস্কর জঙ্গিরা কীভাবে দেশে ঢুকবে, কোথায় বিস্ফোরক মজুত করা থাকবে, কীভাবে হামলা চালানো হবে, গোটা অপারেশনের ব্লুপ্রিন্ট নিজের হাতে তৈরি করত সমীর। যেমন মেধা তেমনই যুদ্ধে পারদর্শী সমীর। অ্যাণ্টি টেররিস্ট স্কোয়াড সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৬-এ পাকিস্তান থেকে আসা যে বিপুল পরিমাণ আরডিএক্স, একে ৪৭ রাইফেল ও কার্তুজ ঔরঙ্গাবাদ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তার পিছনেও শেখ সমীরের সক্রিয় ভূমিকা ছিল৷ ২০১৪-এর ২৫ আগস্ট সেই মামলার হাজিরা দিতেই হাওড়া-মুম্বই এক্সপ্রেসে করে তাকে মুম্বইয়ের এমসিওসিএ কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল৷ ছত্তিশগড়ের রায়গড় স্টেশনের কাছে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালায় সে৷ রিপোর্টে বলা হয়, সাতজন পুলিশকর্মীর চোখে ফাঁকি দিয়ে খরসিয়া এবং সাক্তি স্টেশনের মাঝে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালায় সমীর৷ সমীরের মা কমার নাসরিন করিম আদালতে অভিযোগ করেছিলেন, সমীরকে এনকাউন্টারে মেরে ফেলেছে পুলিশ।

অন্যদিকে, সমীরের বাকি তিন সঙ্গীকে ২০১৭-তে ফাঁসির সাজা দেয় বনগাঁ আদালত। তিন অপরাধীর সাজা হলেও সমীর ফেরার থাকায় মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। অবশেষে ২০১৭-এ পুলিশের জালে ধরা পড়ে সমীর। উত্তরপ্রদেশ থেকে তাকে পাকড়াও করে এসটিএফ। তাকে নিজেদের হেফাজতে নেয় সিআইডি। বনগাঁ আদালতে ফের শুরু হয় সেই অমীমাংসিত মামলা। দেশদ্রোহিতা এবং দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সমীরকে দোষী সাব্যস্ত করে বনগাঁ আদালত।