মাথায় গেঁথে জঙ্গিদের ছোঁড়া বুলেট, লড়াই ছাড়েনি সৌম্যদীপ, এক বীরের কাহিনি


ছোট্ট একটা প্রাণ। ছোট্ট একটা শিশু। বয়সই-ই বা কত? মেরেকেটে ১৩ অথবা ১৪। কিন্তু, জঙ্গিদের সামনে রুখে দাঁড়াতে ভয় পায়নি সৌম্যদীপ। পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের সৌম্যদীপের মাথায় গেঁথে যায় জঙ্গিদের এক ৫৬-র রাইফেল থেকে ছোঁড়া গুলি। আপাতত হুইল চেয়ারই তার আশ্রয়। তবু লড়াই ছাড়েনি সৌম্যদীপ। সে ফের ছুটে বেড়াতে চায় ফুটবল পায়ে। ফিরে আসতে চায় ব্যাডমিন্টনের কোর্টে। 

সৌম্যদীপের সাহসিকতাকে কুর্ণিশ জানিয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তার শৌর্যের জন্য সম্মানিত করেছে এই সংস্থা। আপাতত দিল্লিতে সেনাবাহিনীর 'রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেল' হাসপাতালে তার চিকিৎসা চলছে।

২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জম্মুর সঞ্জুওয়ান আর্মি ক্যাম্পে হামলা চালায় জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গি গোষ্ঠীর 'আফজল গুরু স্কোয়াড'। ভোর রাতে হওয়া এই হামলায় আতঙ্ক ছড়ায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে। কারণ এখানে পরিবার নিয়ে বহু সেনাকর্মী বাস করেন। সৌম্যদীপের বাবা হাবিলদার হরিপদ জানা-কেও জঙ্গি প্রতিরোধে কোয়ার্টার ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল।

কোয়ার্টারে মা মধুমিতা ও নয় বছরের বোন স্নেহার সঙ্গে ছিল সৌম্যদীপ। কিন্তু জঙ্গিরা সেনাকর্মীদের ফ্য়ামিলি কোয়ার্টারগুলোতেও ঢুকে পড়ে এলোপাথাড়ি গুলি ও গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকে। যেন এক তপ্ত যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছে সঞ্জুয়ান আর্মি ক্যাম্প। বিপদ বুঝে মা ও বোনকে নিয়ে একটি ঘরে লুকিয়ে পড়ে সৌম্যদীপ। দরজার সামনে ভারী আলমারি, বাক্স, টেবিল দিয়ে প্রতিরোধ তৈরি করে। এমনকী সেই সব জিনিসের উপরে নিজে চেপে বসে থাকে। ততক্ষণে সৌম্য়দীপদের কোয়ার্টারের সদর ভেঙে জঙ্গিরা ঢুকেও পড়েছিল। সামনের ঘরের দরজা বন্ধ দেখে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। এরপর একে ৫৬ রাইফেল থেকে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে। গ্রেনেডের সপ্লিন্টারের আঘাতে গুরুতর জখম হয় সৌম্যদীপ। জঙ্গিদের ছোঁড়া গুলি তাঁর মাথায় গেঁথে যায়। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর সার্চ টিম সেখানে চলে আসায় পালিয়ে যায় জঙ্গিরা।

এই ঘটনার সময় আর্মি স্কুলের ক্লাস এইটে পড়ত সৌম্যদীপ। খেলাধূলোয় খুবই চৌখস ছিল সে। দীর্ঘদিন কোমায় থাকার পর জ্ঞান ফেরে তার। আগের স্মৃতি এখন সেভাবে খেয়ালই করতে পারে না সে। হুইল চেয়ারে বন্দি হয়ে থাকা জীবনে তবু আশার আলো খুঁজে বেড়ায় সৌম্যদীপ। ফুটবল, ব্যাডমিন্টন-টা এখনও তার কাছে প্রজাপতির মতো ইচ্ছেডানাটাকে মেলে দিতে চায়। দৃঢ় প্রত্যয়ে ধীর কন্ঠে সে বলে চলে লড়াই না হারার কথা। বলে ফেলে ফুটবল আর ব্যাডমিন্টনের দুনিয়ায় ফিরে আসার কথা।

সৌম্যদীপের বাবা হরিপদ জানা ছেলের জন্য আজ গর্বিত। যেভাবে নিজের জীবনকে বাজি রেখে সে মা ও বোন-কে বাঁচিয়েছে সেই কাহিনি বলতে গিয়ে হরিপদ-রও গলাও বুঁজে আসে। আক্ষেপ একটাই এমন সন্তানকে সরকার কোনও স্বীকৃতি দেয়নি, না রাজ্য সরকার না মোদী সরকার। তারা কি আদৌ খোঁজ রাখেন এমন সৌম্যদীপের?

সৌম্যদীপের শরীর নিয়ে চিন্তিত পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের পায়রাচালির দলবার গ্রাম। এখানে থাকা সৌম্যদীপের পরিজনদেরও একটাই আক্ষেপ, জীবন বাজি রেখে যে অন্যদের বাঁচাল, সে হারিয়ে ফেলল অনেক কিছু।

রাত পোহালেই দেশের বুকে আরও এক প্রজাতন্ত্র দিবস। দেশের রাষ্ট্রনায়করা বিউগলের ধ্বনি আর কুচকা আওয়াজে আরও এক সাধারণতন্ত্র দিবসের উদযাপন করবেন। কিন্তু এমন এক দিনে সৌম্যদীপ-কে কি সম্মানিত করা যেত না? এই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাবে।