বামেদের ধর্মঘটকে প্রথম দিনেই তামাশায় পরিণত করল রাজ্যবাসী


সকাল সওয়া ৭টার বিবেকানন্দ রোড। এক-একটি সরকারি-বেসরকারি বাস থেকে খুদে পড়ুয়াদের নিয়ে নেমে অভিভাবকরা নির্ভয়ে স্কুলের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন। বাসের ভিড়? আর পাঁচটা দিনের মতোই। রাস্তাঘাট সচল। মানুষজন বেরিয়েছেন। দেখলে কে বলবে, এদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার ১২ দফা দাবিতে সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বিভিন্ন বাম ও ডানপন্থী শ্রমিক সংগঠন! তবে আর পাঁচটি দিনের সঙ্গে একটি-দুটি ফারাক ছিল বৈকি। মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে এদিন প্রচুর এটিএম বন্ধ ছিল। আর বড়সড় ঝামেলার আশঙ্কায় মোড়ে মোড়ে ছিল পুলিস পিকেট। যদিও বড় ঝামেলা দূরঅস্ত, ধর্মঘট যে এখন বাঙালির দু'চোখের বিষ, এদিন তা রাস্তায় নেমে ফের প্রমাণ করল রাজ্যবাসী। তামাশায় পরিণত হল ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সিটু এবং আইএনটিইউসি'র ডাকা দু'দিনের ধর্মঘটের প্রথম পর্ব। যদিও বারাসতে একটি স্কুল বাসে ভাঙচুর চালিয়ে বা শোভাবাজার মোড়ে চলন্ত বাসের তলায় আগুন দিয়ে, সকাল ও বেলায় দফায় দফায় হিংসাত্মকভাবে ট্রেন-বাস অবরোধের চেষ্টা করে ধর্মঘট সফল করার আপ্রাণ চেষ্টা চলে। বেলা যত গড়িয়েছে, গণ পরিবহণে উপচে পড়া ভিড় বুঝিয়ে দিয়েছে, গোড়াতেই দু'দিনের ধর্মঘটকে 'না' বলছে মানুষ। কলকাতা, দুই শহরতলি এবং উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের সর্বত্র কমবেশি একই চিত্র দেখা গিয়েছে।

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য দাবি করেন, ধর্মঘটে অভূতপূর্ব সাড়া মিলেছে। ধর্মঘট ব্যর্থ করতে সরকারের অতিসক্রিয়তা বুঝিয়েছে, বিজেপি'র সঙ্গে তৃণমূলের কতটা আঁতাত। ধর্মঘটী ট্রেড ইউনিয়নগুলির দাবি, চা, ব্যাঙ্ক, বিমা সহ বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে সফল হয়েছে ধর্মঘট। 'আঁতাত'-এর কথা বলেন বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানও। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, এককথায় ধর্মঘট ব্যর্থ। টোটাল ফেলিওর। আজ বুধবার ধর্মঘট করার চেষ্টা হলে 'উত্তম মধ্যম' দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। সূর্যকান্তবাবু পাল্টা বলেছেন, ইট মারলে পাটকেলটাও কিন্তু খেতে হবে। 
এদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গণ্ডগোল, অশান্তি, হিংসা ছড়ানো সহ নানা অভিযোগে কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ মিলিয়ে কয়েকশো ধর্মঘটীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিস। কলকাতা ও উত্তরবঙ্গ থেকে গ্রেপ্তার হন যথাক্রমে ৩৯২ এবং ১৬৫ জন। পরিবহণ দপ্তর সূত্রের খবর, ধর্মঘটীদের তাণ্ডবে ১৩টি সরকারি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাদবপুর এইট বি বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী সহ দলের একাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিন নবান্নে ৯৪ শতাংশ, সল্টলেকের অফিসপাড়ায় ৯৭ শতাংশ ও কলকাতা পুরসভায় ৯৬ শতাংশ হাজিরা ছিল। সেক্টর ফাইভ শিল্পতালুক, কলকাতা বিমানবন্দর ও সল্টলেকের অফিসপাড়া মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। হাওড়া, হুগলি এবং দুই ২৪ পরগনা জেলায় ধর্মঘটের তেমন প্রভাব পড়েনি। সকাল থেকেই হাওড়া স্টেশনে বাস, ট্যাক্সি ও ফেরি-সার্ভিস ছিল স্বাভাবিক। সকালে কয়েকটি জায়গায় রেল ও সড়ক অবরোধ হলেও পরে পুলিস তা তুলে দেয়। অবশ্য শহরের তিনটি নিম্ন আদালতে বিচারপ্রার্থীদের সংখ্যা তুলনায় ছিল কম। হাইকোর্টেও ছিল ছুটির হাওয়া। হাওড়া ও হুগলি শিল্পাঞ্চল মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও, বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের অল্প কিছু কল-কারখানা বন্ধ ছিল। শ্রীরামপুর ও রিষড়ায় রেল অবরোধের সময় ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ে ধর্মঘটীরা। সোনারপুরে একটি বেসরকারি বাসে ভাঙচুর চালানো হয়। বারুইপুর, ব্যান্ডেল মোড়, সোদপুর ও হাওড়ার কদমতলায় ধর্মঘট সমর্থকদের সঙ্গে তৃণমূলের হাতাহাতি হয়। 
দক্ষিণবঙ্গের দুর্গাপুর, জামুড়িয়া এবং কাটোয়ায় বাস ভাঙচুর করা হয়েছে। কাটোয়ায় পুলিস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করেছে। মুর্শিদাবাদের দৌলতবাদে তৃণমূল অফিসে হামলা চালিয়েছে ধর্মঘটীরা। এতে ১৪ জন জখম হন। কৃষ্ণনগরে এক বাসচালককে মারধর করা হয়। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের অফিসগুলিতে কর্মচারীদের উপস্থিতির হার ছিল স্বাভাবিক। বেসরকারি বাস কম চললেও, সরকারি বাস রাস্তায় ছিল। জেলা শহরগুলিতে দোকানপাট আংশিক বন্ধ থাকলেও ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিতে ধর্মঘটের প্রভাব সেভাবে পড়েনি। সকালে ডুয়ার্সের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘটীরা ট্রেন অবরোধ করে। ইটাহারে একটি তেলের ট্যাঙ্কারে ভাঙচুর চালানো হয়। রায়গঞ্জের চণ্ডীতলায় দুষ্কৃতীরা একটি সরকারি বাসে ঢিল ছুঁড়ে কাচ ভেঙে দেয়। চাঁচলে ধর্মঘট সমর্থক ও  বিরোধীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। গাজোলের একলাখি স্টেশনে হাওড়াগামী শতাব্দী এক্সপ্রেসকে প্রায় এক ঘণ্টা আটকে রাখা হয়।