‘ভাগ্যিস ঘুমোইনি, দাউদাউ করে জ্বলছিল, ন’মাসের বাচ্চা কোলে নিয়েই ছুটলাম’


সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছেন তিনি।
অন্য দিন এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকি না। কিন্তু শনিবার ঘুমোইনি। সওয়া ১২টা নাগাদ ফোনে কথা বলছিলাম নাইজিরিয়াবাসী স্বামীর সঙ্গে। 
জানলা দিয়ে হঠাৎ চোখ গেল নীচে। ট্রান্সফর্মার জ্বলছে! মনে পড়ল, রাস্তায় পরপর এতগুলো দোকান। এক বার আগুন ছড়িয়ে পড়লে কী হবে! আশঙ্কাটা মিলে গেল একটু পরেই। দাহ্য পদার্থে ঠাসা দোকানগুলোকে গিলতে শুরু করল আগুন। 

আমার মায়ের এই ফ্ল্যাটটা গড়িয়াহাটের পোশাক বিপণি 'ট্রেডার্স অ্যাসেম্বলি'-র উপরের তলার পিছনের দিকে। আমার মাথায় তখন চিন্তার পাহাড়। কী করে ন'মাসের সন্তান এবং বয়স্কা মাকে নিয়ে নেমে যাব নিরাপদ জায়গায়। 
দৌড়লাম ঘরে। ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে, মাকে ধরে কোনও রকমে সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে নেমে আসি। কিন্তু ও ভাবে তো শীতের রাস্তায় কয়েক মাসের বাচ্চাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। কাছাকাছির কোনও গেস্ট হাউসে মাথা গোঁজা যায় কি না, সেই চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সবগুলোই প্রায় ভর্তি। বিয়ের মরসুম। অনেক ক্ষণ চেষ্টার পরে একটা অতিথিশালা খোলার ব্যবস্থা করা গেল। অন্য ফ্ল্যাটের লোকজনও এলেন। মেঝেতে পেতে দেওয়া হল তোষক। সেখানেই বয়স্কেরা বসে রাত কাটালেন। আমার বাচ্চাটাও সেখানেই কিছু ক্ষণ ঘুমোল। রাত ২টো থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম।

অতিথিশালার দরজা খোলানোর সময়ে পুলিশ আমাদের খুব সাহায্য করেছে। মানবিকতার মুখ হয়ে ওঠেন উড়ালপুলের নীচের বাসিন্দারাও। স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে নীচে নামছিলাম। চার্জ শেষ হওয়ায় ফোনটা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তার আগে ও 'আগুন' কথাটা শুনেছিল। সেই অবস্থায় দূর দেশে চিন্তায় পড়াটাই তো স্বাভাবিক। উড়ালপুলের নীচে রোজ রাত কাটানো মানুষগুলোই আমার ফোনে চার্জের ব্যবস্থা করে দেন। 

গত বছর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গড়িয়াহাটে মায়ের কাছে আসি। মার্চে চলে যাব। তার আগেই এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। আমাদের বাথরুমটা পুড়ে গিয়েছে। এই ধরনের বহুতলে আগুন লাগলে কী হতে পারে, আনন্দবাজারে তার অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমরাও নানা জায়গায় অভিযোগ জানিয়েছি। তবুও তো সেই বিপদের মধ্যেই বাস করতে হচ্ছে।

আমাদের বাড়িটার পাশেই কয়েক কোটি টাকা খরচ করে রেস্তোরাঁ হয়েছে। ফুটপাতে এত রোলের দোকান। ব্যাগের দোকান। চার দিকে দাহ্য পদার্থ। সরকারি নজরদারিও নাকি চলে। তা সত্ত্বেও তো দেখা গেল, কত ফাঁক! না-হলে কি মাঝরাতে ন'মাসের সন্তান নিয়ে ছোটাছুটি করতে হয় রাস্তায়!