মমতার ধরনা-মঞ্চ যেন সেই ইউনাইটেড ইন্ডিয়া


বছর ১৩ পরে আবার সেই ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে ধরনায় বসলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৩ বছর আগে ছিল সিঙ্গুরে অনিচ্ছুকদের জমি ফেরানোর দাবিতে অনশন ও ধরনা। তিনি তখন রাজ্যের বিরোধী নেত্রী। আর রবিবার সন্ধ্যায় ধরনায় বসলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বারের ইস্যু কলকাতার পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে সিবিআই হানা। রাত পৌনে ন'টায় মুখ্যমন্ত্রী ধরনায় বসার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে গোটা ঘটনাই মোড় নেয় জাতীয় রাজনীতির দিকে। বিজেপি-বিরোধী একের পর এক নেতা মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করেন।

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ফোনে বলেন, 'আমরা আপনার পাশে আছি। আপনার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করব।' এর আগে প্রথম ফোনটি আসে লখনৌ থেকে। উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, সমাজবাদী নেতা অখিলেশ যাদব ফোনে মুখ্যমন্ত্রীকে পাশে থাকার বার্তা দেন। এর পর ফোন করেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী, জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা, এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ার, ডিএমকে নেতা এমকে স্ট্যালিন, অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু প্রমুখ। ফোন করেন গুজরাটের দুই তরুণ নেতা হার্দিক প্যাটেল, জিগনেশ মেওয়ানি, লালু-পুত্র তেজস্বী যাদবও। প্রায় সব নেতাই পরে টুইট করে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থাকার কথা জানিয়ে দেন।

রাহুল গান্ধী বলেন, 'মমতাদির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বাংলায় যা হচ্ছে, তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর মোদী ও বিজেপির নজিরবিহীন আক্রমণ। সমস্ত বিরোধী শক্তি এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ।' ধরনায় বসার আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, 'গত ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেডে বিরোধী সমাবেশকে দেখেই বিজেপি মরিয়া আক্রমণ চালাচ্ছে।' ওই সমাবেশকে মুখ্যমন্ত্রী ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ফ্রন্ট বলে অভিহিত করেছিলেন। দেখা গেল, ধরনা ঘিরে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেই ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ফ্রন্টই তৃণমূল নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছে।

সিবিআই, ইডির তৎপরতা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই তিনি অনেক বেশি সরব। এ দিন সন্ধ্যায় সরাসরি কলকাতার পুলিশ কমিশনারের (সিপি) বাড়িতে হানা দেয় সিবিআই। প্রতিবাদে রাজীব কুমারের লাউডন স্ট্রিটের বাংলোয় ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে দীর্ঘ বৈঠকের পরে সিপি-র বাংলোর বাইরে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেন, 'প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গোটা ঘটনার জন্য দায়ী। এই ঘটনা রাজ্য প্রশাসনে হস্তক্ষেপের সামিল।' এর বিরুদ্ধে গোটা দেশকে সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ধরনায় বসার কথা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, 'এই ধরনা আসলে সত্যাগ্রহ।'

সিঙ্গুরের জমি পুনরুদ্ধারে টানা ২৬ দিন অনশন, ধরনায় ছিলেন বিরোধী নেত্রী মমতা। সেই আন্দোলন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম মাইলস্টোন। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মত, সে ধরনা-অনশন তাঁকে বাংলার মসনদে পৌঁছে দিতে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিল। উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা বাংলা। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিভিন্ন দল ও ব্যক্তি। রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী, এমনকী দেশ-বিদেশের বহু নামী ব্যক্তিত্ব তাঁর আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। রবিবার শুরু হওয়া তাঁর ধরনা আন্দোলন কত দিন চলবে, সেটা এখনই স্পষ্ট নয়।

মমতা বলেন, '১৯-এর ব্রিগেড না-করার জন্য আমাকে অনেক ভাবে চাপ ও ভয় দেখিয়েছিল ওরা (বিজেপি)। শুনিনি বলেই ওরা এ রকম করছে।' এর পর আরও সরাসরি আক্রমণে যান মমতা। দেশের সব বিরোধীকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ করেছেন বলেই যে তাঁকে এবং তাঁর সরকারকে টার্গেট করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট করে তিনি বলেন, '১৯-এর ব্রিগেডের পরে ওরা সিবিআই অফিসারদের ডেকে বারবার বলেছে, কুছ তো করো, কুছ তো করো...।'

২০১১ সালে চিটফান্ড কেলেঙ্কারি সামনে আসার পরেই সারদা কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে কাশ্মীর থেকে গ্রেপ্তার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ। সেই প্রসঙ্গ টেনে মমতা দাবি করেন, '১৯৮০ সাল থেকে রাজ্যে সক্রিয় চিটফান্ড আটকাতে সিপিএমের সরকার বা পরে বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার কোনও কাজ করেনি।' চিটফান্ড তদন্ত করতে তিনি যে সিট গঠন করেছিলেন, সে প্রসঙ্গ টেনে মমতা বলেন, 'সেই সিটে রাজীবরা কিছু তদন্ত করেছিল। সব আমাদের কাছে আছে। কেন আমরা সব তথ্য ওদের হাতে তুলে দেব?' জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের প্রসঙ্গ তুলে এনে মমতার কড়া বার্তা, 'নরেন্দ্র মোদী যা বলছেন, মিস্টার ডোভাল তাই-ই করছেন।'

নির্বাচনের আগে তাঁর সরকারকে সমস্যায় ফেলে তাঁর উপরে চাপ তৈরি করতে সিবিআই-সহ অন্য কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান মমতা। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'যখন ভোট আসে, তখনই চিটফান্ডের নাম করে ওরা ঢুকে পড়ে। আগের পঞ্চায়েত, লোকসভা, বিধানসভা ভোটেও তাই করেছে। সামনে আরও একটা ভোট। তার একমাসও বাকি নেই। বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের নাম করে যাকে পারছে তুলছ, যেখানে পারছে ঢুকে পড়ছে।'