রাস্তায় পড়ে নিহতদের ব্যাগ-রুকস্যাক, কান্না চেপে সেগুলো কুড়চ্ছেন সেনারা

মৃত্যুমিছিল: পুলওয়ামায় গাড়িবোমা হামলার পরে উদ্ধারকাজ। বৃহস্পতিবার। 


বৃহস্পতিবার সারাটা দিন সূর্যের মুখ দেখেনি অবন্তীপোরা। বিকেলে কনকনে ঠান্ডা আর টিপটিপে বৃষ্টির মধ্যে সেনাদের গড়া ব্যারিকেডে গাড়ি থেমে যাওয়ায় যখন হেঁটে এগোতে হল, তখনও ভাবা যায়নি কী বীভৎস ছবি অপেক্ষা করছে সামনে। প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে সেনাদের ছুটোছুটি, অ্যাম্বুল্যান্সের হুটার শুনতে শুনতে হঠাৎই যেন একটা ধাক্কা। ভিজে রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে রক্ত-মাংস, মানব দেহের নানা অঙ্গের টুকরো। তারই পাশে পড়ে উড়ে যাওয়া ট্রাকের যন্ত্রপাতির অংশ, নাটবল্টু। পোড়া ডিজেল-মোবিলের কালোর পাশেই কালচে লাল টাটকা রক্তের পোঁচ। বাতাসে পোড়া গন্ধ— পথ ভুলে কি যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পড়েছি?

খুব কাছেই অবন্তীপোরার বাজার। দোকানপাট খোলা থাকলেও কেউ নেই। এক এক করে জড়ো হচ্ছেন মুক্তার দার, মুহম্মদ আজমের মতো দোকানিরা। বাড়ি থেকে আসা উদ্বিগ্ন ফোনের জবাবে জানাচ্ছেন— 'ঠিক আছি, তবে দোকানের কাচ ভেঙে গিয়েছে। উপড়ে এসেছে ডান দিকের পাল্লাটা।' বিস্ফোরণের অভিঘাতে বহু বাড়ির একই দশা। ফাটল ধরেছে কোনও কোনওটির দেওয়ালে। কান ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দে গোটা বাজার খালি হয়ে গিয়েছিল নিমেষে। যে যেখানে পেরেছেন গা-ঢাকা দিয়েছেন। ফিসফিস করে মুক্তার বললেন, ''রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে ছিলাম। একটা একটা করে সেনাদের গাড়ি যাচ্ছিল। হঠাৎই চার পাশ কেঁপে উঠল ভয়ানক শব্দে। যেন একটা আগুনের গোলা উঠে গেল আকাশে। কালো ধোঁয়া। দেখলাম সবাই ছুটছে। আমিও পিছু নিলাম।''

ব্যাট তৈরির দোকান শহিদ ইমরানের।  তাঁর বর্ণনা, ''হঠাৎ ভয়ঙ্কর আওয়াজের পরেই দেখি চার দিকে কালো ধোঁয়া। দোকান খোলা রেখেই ভয়ে পালাই। কী হয়েছে বুঝিনি।'' শহিদ জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের পরে গুলি চলার আওয়াজও পেয়েছেন তিনি। আর এক প্রত্যক্ষদর্শী হাবিবুল্লার কথায়,  ''জওয়ানদের দেহের টুকরো ছড়িয়ে ছিল রাস্তায়। একটি পোড়া স্করপিয়ো গাড়ি ও বাসও দেখতে পাই।'' ওষুধের দোকানের মালিক মুহম্মদ আজম স্বীকার করলেন, এত বড় ঘটনা প্রথমে বুঝতেই পারেননি। কিন্তু এত ভয়ানক শব্দও তিনি শোনেননি জীবনে।

রাস্তায় পড়ে নিহত জওয়ানদের ব্যাগ, রুকস্যাক। এক দল সেনা ঘুরে ঘুরে রাস্তা থেকে সেগুলি কুড়িয়ে বড় বস্তায় রাখছেন। কাছে আসতে দেখলাম তাঁদের চোখে জল। ফুঁপিয়ে কাঁদছেন পাথরে কোঁদা শক্ত চেহারার মানুষগুলি। এক জন এগিয়ে এসে বললেন, ''দেখুন কী ভয়ানক কাণ্ড! অন্তত সাড়ে তিনশো কিলো বিস্ফোরক জড়ো করেছিল ওরা। ২২টি গাড়ি উড়ে যায় এতে!'' কথা বলতে বলতেই ফোন এল তাঁর বাড়ি থেকে। এ বার কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ''ম্যায় তো ঠিক হুঁ, লেকিন...।'' ফোনের মুখ চেপে একটু দূরে সরে গেলেন ওই জওয়ান।

হামলার পরেই দক্ষিণ কাশ্মীরের ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আগামী কাল সকাল পর্যন্ত  গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে জাতীয় সড়কে।