সন্ধে নামলেই চোখে রক্তের ধারা, শাপমুক্ত করল এসএসকেএম


যেন হলিউডি হরর ফিল্মের হাড়হিম দৃশ্য! সূর্য অস্ত গেলেই চোখ দিয়ে অঝোরধারার রক্তস্রোত। প্রতি সন্ধ্যায় আটপৌরে মায়ের সেই বদলে যাওয়া বীভৎস চেহারা দেখে বালিকা দুই মেয়ে আতঙ্কে কাঁটা।


একি কোনও রোগ! নাকি অপদেবতার কারসাজি?

দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন হুগলির চণ্ডীতলার তেত্রিশ বছরের বধূ সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজ্ঞানমনস্ক মনে ছায়া ফেলতে শুরু করেছিল অলৌকিক নানা গল্পগাথা। একটা সময় নাক, ঠোঁট, গাল, পা বেয়েও রক্তক্ষরণ শুরু। এমন অবস্থা হয় যে, বাড়ির লোকজন তাঁর কাছে ঘেষতে ভয় পাচ্ছিলেন। আঁধার ঘনালেই সবার বুকে দুরুদুরু। এই আরম্ভ হবে রক্তের খেলা!

শারীরিক কষ্টের সঙ্গে দুর্বিসহ মানসিক যন্ত্রণাও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছিল বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের বধূকে। ধাওয়া করেছিল মৃত্যু ভয়। পিজি হাসপাতালের 'ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রি' (আইওপি)-র আউটডোরে বসে নাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন সেই ভয়ংকর দিনগুলির কথা। সুস্মিতা এখন শাপমুক্ত। আইওপি-র কল্যাণে সুস্থ। মঙ্গলবার রেগুলার চেক-আপে এসেছিলেন। সেখানেই বললেন, সেই রক্তেভেজা ভয়ংকর দিনগুলির কথা। তাঁর কথায়, চোখ-নাক নিয়ে দরদর করে রক্ত বেরিয়ে আসত। আয়নার সামনে দাঁড়ানোর সাহস ছিল না। নিজেকে 'রাক্ষসী' মনে হত। চোখের কোণে দেড় সেন্টিমিটার জায়গা জুড়ে রক্ত জমাট বেধে থাকত। সুস্মিতার স্বামী মানসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য সরকারি কর্মী। তিনি জানালেন, অনেকদিন আগে মাথায় আম পড়েছিল। ভেবেছিলাম, তার থেকেই বোধহয় কিছু হয়েছে। প্রথমে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল তাঁর স্ত্রীর, তারপরই রক্ত বেরনো শুরু। আর এটা হলেই ওঁর রক্তচাপ ষাট বাই পঁচাত্তর হয়ে যেত। হারিয়ে যেত চেতনা।

সময়টা ছিল ২০১৭ সালের জুলাই। প্রথমে স্থানীয় এক নিউরোলজিস্ট দেখেন সুস্মিতাকে। তাঁর ওষুধ কাজ করেনি। তাঁর পরামর্শেই সুস্মিতাকে পিজি হাসপাতালের 'বাঙুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজি'-তে দেখানো হয়। সেখানকার চিকিৎসক 'আইওপি' যাওয়ার পরামর্শ দেন। সুস্মিতাকে পরীক্ষা করেন আইওপি-র ডাক্তারবাবুরা। জানা যায়, বিরল 'ডিসথাইমিয়া ইউথ সাইকোজেনিক পারপিউরা'তে আক্রান্ত হয়েছেন রোগী। আইওপির অধিকর্তা ডা. প্রদীপ সাহা জানালেন, রক্তের উপাদানে সমস্যার কারণে অনেকসময় এটা হতে পারে। কিন্তু সেটাও বিরল। ১০ লাখে একজনের হয়। কিন্তু টেনশন চেপে রাখার কারণে চোখ দিয়ে রক্তের ধারা অত্যন্ত বিরল। ২০ লাখে একজনের হয় কি না সন্দেহ।

কিন্তু সন্ধের পর কেন উপসর্গ' চিকিৎসকরা বলছেন এটা কাকতালীয়। কিছু মানুষের সকালের দিকে হতাশা বেশি গ্রাস করে। কারও আবার সন্ধের পর। সুস্মিতা দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত। শেষের দিকে দিনের বেলায়ও রক্ত বেরিয়েছে চোখ থেকে। টানা চোদ্দ মাস চলেছে রক্তের অত্যাচার! তবে, গত পাঁচ মাসে একবারও রক্তপাত হয়নি। এমনটাই জানালেন সুস্মিতা। বললেন, "আমার চোখ থেকে এতটাই রক্ত বেরোত যে বালিশ ভিজে যেত। বালিশের কভার নিংড়ালে এক গ্লাস রক্ত বেরোত। কিছুদিন পর পা থেকেও রক্তপাত শুরু হয়।হতাশা পুষে রেখেই সুস্মিতার এই দশা হয়েছিল। পর্যবেক্ষণ প্রদীপবাবুর। জানালেন, বিয়ের পর সুস্মিতার প্রথমে ছেলে হয়। ৩৮ দিনের মাথায় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ছেলেটির মৃত্যু হয়। তারপর পরপর দুই মেয়ে। মনে আশা থাকলেও ছেলে হয়নি। সেই স্বপ্নভঙ্গ থেকে হতাশার জন্ম। ছোট মেয়ে জন্মানোর পর চক্রবৃদ্ধি হারে তা বাড়ে। তাতেই জন্ম নেয় 'সাইকোজেনিক পারপিউরা'।