'তাড়াতাড়ি ফিরব'...কফিনবন্দি হয়ে বাড়ি ফিরছে পুলওয়ামায় শহিদ নদীয়ার সুদীপের ঝলসানো দেহাংশ


পুলওয়ামায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় এরাজ্যের জওয়ানের মৃতের সংখ্যা বেড়ে হল ২। হাওড়ার উলুবেড়িয়ার পর এবার নদীয়ার আরও এক জওয়ানের মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছল গ্রামের বাড়িতে।

নদীয়ার তেহট্টের হাঁসপুকুরিয়া গ্রামের ছেলে সুদীপ বিশ্বাস। ছোট থেকেই স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনী যোগ দেওয়ার। সেই স্বপ্ন সত্যিও হয়েছিল। সিআরপিএফ-এ যোগ দিয়েছিলেন সুদীপ। গ্রামের ছেলে সেনাবাহিনীতে, গর্বের অন্ত ছিল না স্থানীয় বাসিন্দাদের। কিন্তু সবটাই 'ছিল' ১৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত। জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ের উপর সিআরপিএফ কনভয়ে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় শহিদ হয়েছে নদীয়ার জওয়ান সুদীপ বিশ্বাস।

বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টেয় গ্রামের বাড়িতে ফোন করেছিল সুদীপ। সেটাই ছিল শেষ ফোন। পরিবারের সঙ্গে শেষবারের মতো তখনই সুদীপের কথা হয়। ফোনে সুদীপ মা, বাবকে চিন্তা করতে বারণ করেছিল। এবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে বলে আশ্বস্ত করেছিল সে। বাড়ি 'ফিরছে' সুদীপ, তবে কফিনবন্দি হয়ে। ফিরছে সুদীপের মরদেহও নয়! ফিরছে বিস্ফোরণে ঝলসে যাওয়া দেহাংশ।

কাল বিকেলে বাড়িতে ফোন করার আধঘণ্টার মধ্যেই জম্মু-শ্রীনগর হাইওয়ের উপর সিআরপিএফ কনভয়ে ফিঁদায়ে জঙ্গি হামলা হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে সাড়ে ৩টে নাগাদ পুলওয়ামার অবন্তীপোরায় সিআরপিএফ কনভয়ে ফিঁদায়ে হামলা চালায় জইশ-ই-মহম্মদের জঙ্গি আদিল। ৩৫০ কেজি বিস্ফোরকবোঝাই এসইউভি নিয়ে এসে কনভয়ের একটি গাড়িতে ধাক্কা মারে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় পুড়ে খাক হয়ে যায় কনভয়ের সেই গাড়িটি। সেই কনভয়েই ছিল তেহট্টের সুদীপ।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেই কনভয়ে জঙ্গি হামলার খবর পেয়েছিল সুদীপের বাড়ির লোক। আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠেছিল। রাতে সুদীপের সঙ্গে বার বার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে বাড়ির লোক। কিন্তু কোনভাবেই সুদীপের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এরপর শুক্রবার সকাল থেকেই সিআরপিএফ থেকে বার বার ফোন আসে গ্রামের বাড়িতে। সুদীপের সম্পর্কে নানারকম তথ্য জানতে চাওয়া হয়। তিল আছে কিনা, তিল থাকলে কোথায় আছে, চশমা পড়ত কিনা, সুদীপ সম্পর্কে একের পর এক প্রশ্ন করা হয় বাড়ির লোককে। 

প্রতিবার ফোনে আশঙ্কায় দুরু দুরু করে উঠছিল বুকটা। কিন্তু তখনও মন মানতে চায়নি যে খারাপ কিছু সত্যিই ঘটে গিয়েছে! বেলা গড়াতে শেষপর্যন্ত সত্যি হল সেই আশঙ্কা-ই। জঙ্গি হামলায় শহিদ হয়েছে ঘরের ছেলে। মা, বাবা আর এক বোনকে নিয়ে ছোট্ট ছিমছাম সংসার ছিল সুদীপের। সিআরপিএফ-এ যোগ দেওয়ার পর ঘরে কিছু টাকা এসেছিল। সেই উপার্জনকে সম্বল করেই সদ্য বোনের বিয়ে দিয়েছিল সিআরপিএফ জওয়ান দাদা। 

নিজের এখনও বিয়ে হয়নি। দেখাশোনা শুরু হয়েছিল। বিয়ের আগে একটা পাকা ঘরের করার দরকার ছিল খুব। তাই বাড়ির কাজও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্ত, বৃহস্পতিবারের আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় এক মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে গুঁড়িয়ে চুরমার করে দিয়েছে সব স্বপ্ন। একমাত্র ছেলে, সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম, সুদীপকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গিয়েছেন বৃদ্ধ বাবা সন্ন্যাসী বিশ্বাস। কান্নায় ভেঙে পড়েছেন মা মমতা বিশ্বাস। বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। 

দুঃসংবাদ পাওয়ার পরই গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছে সুদীপদের ছোট্ট বাড়িটায়। কিন্তু বৃদ্ধ, অসহায় বাবা-মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর শহিদ জওয়ানের বাড়ি গিয়ে পৌঁছেছে পুলিসও। ভয়াবহ এই জঙ্গি হামলায় এখনও পর্যন্ত ৪৪ জন জওয়ান শহিদ হওয়ার খবর মিলেছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় এখনও সেনা হাসপাতালে চিকিত্সাধীন রয়েছেন বেশ কয়েকজন জওয়ান।