৭০০ পড়ুয়ার মৃতদেহের স্তূপে আফ্রিকায় এসেছিল ভাষার অধিকার


বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের সম্মানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় বিশ্বজুড়ে৷ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি আত্মমর্যাদা অধিকারের দিন৷ একটি রাষ্ট্রের জন্ম নেওয়ার শুরুর পর্ব৷ তবে ভারত সহ একাধিক দেশে বারে বারে হয়েছে ভাষা আন্দোলন৷ সেই তালিকায় সর্বাধিক জীবন রাজপথে পড়ে থাকার মর্মান্তিক ঘটনাটি কিন্তু সুদূর আফ্রিকায়৷

প্রায় অনুচ্চারিত থাকে মহান এই ভাষা আন্দোলন৷ অন্তত ৭০০ জন পড়ুয়া (বেসরকারি হিসেব) জীবন দিয়ে জুলু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ বর্ণবাদ ও বৈষম্যের অভিশাপে রক্তাক্ত সেই আফ্রিকা৷ সেদিন শাসকের বন্দুক থেকে গুলি ছড়িয়েছিল বৃষ্টির মতো৷ আর বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের একটার পর একটা মৃতদেহ তৈরি করেছিল মৃত্যুর উপত্যকা৷

একাধিক ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশে বিভক্ত আফ্রিকার বিভিন্ন ভূখণ্ড বারে বারে স্বাধীনতা, বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে৷ অধিকার লড়াইয়ের সেই সব দশকে কেঁপে গিয়েছে দুনিয়া৷ 'মানহারা মানবী'-এর পাশে দাঁড়িয়েছে একের পর এক দেশ৷ তীব্র আন্তর্জাতিক টানাপোড়েনের মাঝেই ঘটেছিল সেই রক্তাক্ত মুহূর্ত৷ ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন-বিশ্বের ভাষা আন্দোলনের সর্বাধিক রক্তাক্ত দিন৷
 
ঘটনাস্থল দক্ষিণ আফ্রিকার শহর সোয়েটো৷ তখন অবশ্য এই দেশ ট্রান্সভাল প্রদেশ নামেই সুপরিচিত৷ বিখ্যাত 'রামধনু শহর' জোহানেসবার্গের সংলগ্ন সোয়েটো৷ সেই শহরেই সাতরঙ মুছে গিয়েছিল রক্তের লাল স্রোতে৷ ঘটনার কারণ কি ?

দীর্ঘ সময় ধরে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা এখানকার বাসিন্দারা একটি সরকারি নির্দেশিকা ঘিরে প্রবল ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন৷ ঔপনিবেশিক শাসকের নির্দেশে বিদ্যালয়ে আফ্রিকানা ভাষা চালু হয়েছিল৷ দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত শ্বেতাঙ্গদের সুবিধার জন্য জার্মান-ডাচ ভাষার মিশ্রণে 'আফ্রিকানা' ভাষায় পড়ানোর প্রস্তাবটি আসতেই ক্ষোভের আগুনে ঘি পড়ে৷ শুরু হয় আফ্রিকানা বয়কট ও জুলু ভাষার অধিকার চেয়ে বিক্ষোভ আন্দোলন৷ প্রায় তিন মাস ধরে সেই ক্ষোভ ছড়িয়ে এমন আকার নেয় যে প্রশাসনিক কাজকর্ম শিকেয় ওঠে৷ সেই সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে থাকে আরও জমাট আন্দোলন৷

রক্তাক্ত ১৬ জুন:

জুলু ভাষার অধিকার চেয়ে পথে নামা পড়ুয়াদের রুখতে শুরু হল বিরাট পুলিশি অভিযান৷ যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে মিছিলে শয়ে শয়ে পড়ুয়া অংশ নিতে শুরু করে৷ অচিরেই সেই আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে৷ হিংসাত্মক পরিবেশ তৈরি হতে পারে এই অজুহাত দিয়েই সরকার কড়া হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ জারি করে৷ এরপরেই পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়৷ নির্বিচারে সেই গুলি চালানোয় পড়ুয়াদের মৃত্যু মিছিল শুরু হয়৷ অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি৷ সেদিন সোয়েটো শহরের রাস্তায় রাস্তায় শুধু মৃতদেহের স্তূপ৷ এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব জুড়ে৷ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রতিষ্ঠানে উঠে আসে রক্তাক্ত পড়ুয়াদের ছবি৷ মৃতদেহে ঢেকে থাকা সোয়েটো শহরের দিগন্ত রেখায় তখন ধোঁয়া ছড়াচ্ছিল৷ বারুদের ধোঁয়া৷

বেসরকারি হিসেবে সেদিনের ঘটনায় অন্তত ৭০০ জনের মৃত্যু হয়৷ সবাই বিদ্যালয়ের পড়ুয়া৷ আর সরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ১৭৬ জন৷ বিভিন্ন হাসপাতালে জখম হয়ে চিকিৎসাধীন আরও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছিল৷ মৃতদেহে ঢেকে থাকা সোয়েটো শহর তখন আন্তর্জাতিক বিতর্কের কেন্দ্র৷ শুরু হয় রাষ্ট্রসংঘে প্রতিবাদ৷ নড়ে যায় স্থানীয় সরকার৷

আন্দোলনে সামনের সারিতে থেকে আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য বিরোধী অবস্থানের নেতৃত্বে প্রবল শক্তি নিয়ে উঠে আসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস৷ পরে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান তাদের হাতেই হয়েছিল৷

নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়ে ভাষা আন্দোলন যে কোনও জাতির কাছে গর্বের৷ মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা৷