ফুটপাথ থেকে বিশ্বকাপে, স্বপ্ন সত্যির প্রহর লুসি-তৌহিদদের


ব্রড স্ট্রিটের এক কামরার ঘরে মা-বাবা, পাঁচ ভাই-বোনের সঙ্গে থাকে মহম্মদ ওয়ারিস। দ্বিতীয় শ্রেণির পর স্কুলছুট। মাসখানেক আগে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ওয়ারিস এখন ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত। বিরাট-রুটদের বিশ্বকাপ শুরুর আগে লন্ডন আর ওয়েলসে হবে 'স্ট্রিট২০'--- পথশিশুদের বিশ্বকাপ। ফাইনাল লর্ডসে। বাছাই পর্বের শেষ ল্যাপে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়ারিস এখন পাসপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায়।

অপেক্ষায় তিলজলা রোডের বস্তিবাসী লুসি কুমারীও। নবম শ্রেণির ছাত্রী ছোট থেকেই ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকে। আগে মা বকাবকি করতেন। এখন আর করেন না। ভারত থেকে বিশ্বকাপে যাবে দু'টি দল। একটি উত্তর ভারত থেকে, অন্যটি দক্ষিণ। এক-একটি দলে ৮ জন করে। উত্তর ভারতের দলে ৮ জনই বাংলার। সেই দলে নাম তুলতে সপ্তাহে তিন দিন রবীন্দ্র সরোবরের মাঠে জোর প্রস্তুতি চালাচ্ছে লুসিরা।

গড়িয়াহাটের ফুটপাথে থাকত ক্লাস সেভেনের ছাত্র। কিশোরদের নেশা করতে দেখে মা টালিগঞ্জের একটি হোমে পাঠিয়ে দেন। অঙ্ক ভালো লাগে। ক্রিকেট-ফুটবলও। কিন্তু লর্ডস কী বস্তু, এতদিন জানত না। সেখানে পৌঁছতে এখন মন্ত্র শুধুই ক্রিকেট।

বিশ্বকাপ ফুটবলের আগে পথশিশুদের নিয়ে ফুটবলের অভিনব বিশ্বকাপ বেশ কয়েকবার হয়েছে। ঘরছাড়াদের ফুটবল বিশ্বকাপও নতুন নয়। কিন্তু ২০১৯ সালে প্রথমবার হতে চলেছে পথশিশুদের বিশ্বকাপ ক্রিকেট। মূল বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে। ৭ মে যার ফাইনাল হবে ক্রিকেটের মক্কায়।

অভিনব কাপ। খেলার ধরনও অভিনব। বিরাটদের খেলার সঙ্গে বিরাট ফারাক। গলি ক্রিকেটের ধাঁচায় খেলা হবে ছোট মাঠে। টেনিস বল, তাই প্যাড-গ্লাভসের প্রয়োজন নেই। শিখতে হবে না হাজারো আধুনিক টেকনিকও। ১০টি দেশ যাচ্ছে। প্রথমে দু'টি গ্রুপ ভাগ করা হবে। পাঁচটি দল নিজেদের মধ্যে দু'বার করে খেলবে। সেখান থেকেই সেমিফাইনাল, ফাইনাল। দলের আঙ্গিকেও অভিনবত্ব। আট জনের দল। চার জন ছেলে, চার জন মেয়ে। মাঠে নামবে ছ'জন। চার বল করে ওভার। সবমিলিয়ে কুড়ি বল অর্থাৎ পাঁচ ওভারের খেলা। রান তোলারও হরেক কায়দা। পাশের বা উইকেটকিপারের পিছনের দেওয়ালে লাগলে এক রান, বোলারের পিছনের দেওয়ালে চার। একইসঙ্গে দৌড়েও রান নেওয়া যাবে। ঠিক যে ভাবে খেলা হয় রাস্তার ক্রিকেটে।

আসলে ক্রিকেটকে মুখরা করে লন্ডনে তুলে ধরা হবে শিশুদের অধিকারকেই। তাই সরল করা হয়েছে খেলার ধরন। লুসি-ওয়ারিসরা শিখছেও সে ভাবে। প্রথাগত প্রশিক্ষণ কারও ছিল না। মেয়েদের অনেকে আবার এই প্রথম ব্যাট হাতে নিয়েছে। রবীন্দ্র সরোবরের মাঠে কোচের কাছে খুঁটিনাটি শিখে নিচ্ছে সকলে। আশার আলো হোমের নবম শ্রেণির ছাত্রী যেমন। শখ বিমানসেবিকা হওয়ার। মাসখানেক আগেও ফুটবল শিখছিল। এখন ক্রিকেট মাঠে। বল করতে তেমন ভালো লাগে না। কিপিং আর ব্যাটিংয়েই মন দিয়েছে সে। খিদিরপুর ডকের মহম্মদ তৌহিদ আনসারিরও ব্যাটিংয়ে মন। একদিন নিজেদের মধ্যে ম্যাচে ২০ বলে ৪০ রান তুলেছে সে। সেই ম্যাচ অবশ্য তার দল হেরে যায়। কিন্তু লন্ডন যাওয়ার দৌড়ে হারতে চায় না তৌহিদ। কথায় কথায় বলে, 'কী ভাবে ক্যাচ ধরা উচিত, কোচ শিখিয়েছেন। ফিল্ডিংও ভালো হয়েছে আগের চেয়ে।'

উত্তর ভারত থেকে দল পাঠানোর দায়িত্বে দুই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'সেভ দ্য চিলড্রেন' আর 'হোপ ফাউন্ডেশন'। সেভ দ্য চিলড্রেনের তরফে চিত্তপ্রিয় সাধু বলেন, 'বিশ্ব জুড়ে পথশিশু ও কিশোরদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়, এই অভিনব সুযোগ তা বদলে দেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।' হোপ ফাউন্ডেশনের গীতা বেঙ্কটাকৃষ্ণনের আশা, 'সঙ্কটাপন্ন পথশিশুদের স্বর হয়ে উঠবে এই বিশ্বকাপ।' যেমন, বিলেতে খেলার ফাঁকেই লুসি বলবে, পথশিশুরা কতটা খারাপ থাকে, কেন খারাপ থাকে। তৌহিদ আশায়, তাদের দেখে ফুটপাথের অন্য বাচ্চারাও অনুপ্রেরণা পাবে, শিখবে। ফুটপাথ থেকে বিশ্বকাপে। ক্রিকেট নিমিত্ত মাত্র!