পিএফ আটকে কয়েক লক্ষ জনের


উদয় পাঁজা। চা তৈরির কাজ করতেন ধর্মতলার মিষ্টির দোকানে। দীর্ঘ ৩১ বছর ধরে টাকা কাটিয়েছেন কর্মী প্রভিডেন্ট ফান্ডে (ইপিএফ)। কিন্তু সেখান থেকে 'অবসরের পরে' তিন বছর কেটে গিয়েছে। কিন্তু পিএফের টাকা পাননি। কারণ, পিএফ দফতরে তাঁর যে জন্ম তারিখ নথিবদ্ধ রয়েছে, তার সঙ্গে আধারের তথ্য মিলছে না।

বরাহনগর চটকলে কাজ করতেন সুধাংশু মণ্ডল। অবসর নিয়েছেন প্রায় তিন বছর আগে। কিন্তু এখনও পিএফের টাকা হাতে পাননি তিনিও। কারণ, পিএফের খাতায় নথিভুক্ত নামের বানানের সঙ্গে সামান্য ফারাক রয়েছে আধারে তাঁর নামের বানানে।

শুধু উদয় বা সুধাংশু নন, এ ধরনের ফারাকের কারণে সারা দেশে আটকে রয়েছে কয়েক লক্ষ জনের। তাঁদের অভিযোগ, ''আমাদের নাম, জন্ম তারিখ উল্লেখ করে যে ফর্ম নিয়োগকারী পিএফ দফতরে পাঠিয়েছিলেন, তার ভিত্তিতেই এত বছর ধরে টাকা জমা নেওয়া হল। অথচ টাকা দেওয়ার সময়ে বলা হচ্ছে, ওই কাগজ যথেষ্ট নয়!'' তাঁদের প্রশ্ন, ''তাহলে মাঝে কখনও অন্য প্রামাণ্য নথি চাওয়া হল না কেন? এমনকি পেনশন চালুর সময়েও নয়!''
অভিযোগ

• বছরের পর বছর পিএফের জন্য টাকা কাটিয়েও অবসরের পরে তা হাতে পাচ্ছেন না কয়েক লক্ষ জন।  মূলত এঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মী।

• আটকে রয়েছে পিএফের পেনশনও।
সমস্যার শিকড়

• কয়েক দশক আগে অসংগঠিত ক্ষেত্রে যোগ দেওয়া অনেক কর্মীরই নাম, জন্মের তারিখ ইত্যাদি পিএফের খাতায় ঠিক নেই।

• কেউ আন্দাজে জন্মতারিখ দিয়েছিলেন। কারও টাকা জমা পড়েছে ডাক নামে। সেগুলি নথিভুক্তও করা হয়েছিল স্রেফ নিয়োগকারীর শংসাপত্রের ভিত্তিতে। 

• বছরের পর বছর, এমনকি টানা কয়েক দশক নাগাড়ে টাকা কেটে যাওয়ার সময়ে তা নিয়ে কোনও আপত্তি তোলেনি পিএফ দফতর। চাওয়া হয়নি অন্য কোনও প্রমাণপত্র।

• কিন্তু এখন আধারের সঙ্গে ওই সমস্ত তথ্য না মিললে, জমানো টাকা দিতে বেঁকে বসছে তারা। জানিয়ে দিচ্ছে, আধার, ভোটার কার্ডের সঙ্গে তথ্য না মিললে, টাকা দেওয়া সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।
প্রশ্ন যেখানে

• জমানো টাকা দেওয়ার জন্য যদি আধারের মতো সরকারি নথিই একমাত্র বিবেচ্য হয়, তাহলে তা আগে চাওয়া হল না কেন?

• কেন সেই কথা উঠল না ১৯৯৫ সালে পিএফের পেনশন চালুর সময়ে?

• নিয়োগকারীর সই করা কাগজ যদি টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রামাণ্য নথি না হয়, তাহলে এত বছর ধরে তার ভরসায় টাকা জমা নেওয়া হল কী ভাবে? কেন মাঝে বন্দোবস্ত হল না নাম, জন্ম তারিখ যাচাইয়ের?

• জমানো টাকা আটকে থাকার ভোগান্তি কি কোনও ভাবেই আটকানো যেত না?
আঞ্চলিক পিএফ কমিশনার রাজীব ভট্টাচার্য বলেন, ''এই সমস্যার কথা জানি। কিন্তু আমাদের হাত-পা বাঁধা। দফতরের নথির সঙ্গে আধার, ভোটার কার্ড অথবা অন্য কোনও গ্রাহ্য নথিতে উল্লেখিত জন্ম তারিখ এবং নাম না মিললে, দাবিদারকে টাকা মেটানো সম্ভব নয়। সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় স্তরে নির্দেশিকা তৈরি হওয়া জরুরি।''

কমিশনার যে সব নথির কথা বলছেন, তার মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট, স্কুল লিভিং সার্টিফিকেট, হাসপাতালের দেওয়া জন্ম তারিখের সার্টিফিকেট ইত্যাদি। যা জোগাড় করা অসংগঠিত ক্ষেত্রের অনেক কর্মীর পক্ষেই কঠিন।  

ছোট দোকান, রেস্তোরাঁ, ইট ভাঁটার মতো অসংগঠিত ক্ষেত্র ছাড়াও চটকল বা চা বাগানে ২৫-৩০ বছর আগে যাঁরা কাজে যোগ দিয়েছেন, বহু ক্ষেত্রে তাঁদের জন্ম তারিখের সঠিক নথি ছিল না। চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময়ে নিয়োগকারী জন্ম তারিখ বসিয়ে দিতেন নথিতে। পিএফ দফতরেও তা পাঠানো হত। কিন্তু আধার, ভোটার কার্ডে লেখা নাম বা জন্ম তারিখের সঙ্গে তার ফারাক দেখা যাচ্ছে।

ইউটিইউসির সাধারণ সম্পাদক অশোক ঘোষের অভিযোগ, ''পিএফ দফতর দ্বিচারিতা করছে। টাকা নেওয়ার সময়ে নিয়োগকারীর দেওয়া জন্ম তারিখ মানা হয়েছে। পরে কখনও তা যাচাই করা হয়নি। অথচ টাকা মেটানোর সময়ে নিয়োগকারীর নথি মানা হচ্ছে না। সমস্যাটি জানালেও কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ব্যবস্থা নেননি।'' 
পিএফের অছি পরিষদের প্রাক্তন সদস্য ও এআইইউটিইউসির সাধারণ সম্পাদক শঙ্কর সাহা বলেন, ''ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী হয়ে ওই ধরনের বেশ কিছু কর্মীর পিএফের ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু স্থায়ী সমাধান এখনও মেলেনি।''