২৫ লাখের বিল, দুই তরুণীর প্রাণ বাঁচিয়ে অর্থাভাবে থমকে নিজেরই চিকিৎসা

সঙ্কট: একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জীবন।


ফাস্টফুডের ছোট্ট দোকানের সামান্য রোজগারে চলে যেত তাঁর একার সংসার। তেমন অভাব ছিল না। তবে কারও প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে যে এমন দিন দেখতে হতে পারে, তা হয়তো কখনও ভাবতে পারেননি জীবনকুমার সরকার। তাঁর আত্মীয়দের মাথায় এখন ২৫ লক্ষ টাকার চিকিৎসা-বিলের বোঝা। চলন্ত ট্রেনের সামনে থেকে দুই তরুণীর প্রাণ বাঁচিয়ে এখন সঙ্কটে জীবনবাবু।

মাস খানেক আগে শ্যামনগর স্টেশনে দুই তরুণীকে ট্রেনে কাটা পড়া থেকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন জীবনবাবু। সে দিন তাঁদের বাঁচাতে পারলেও, নিজে ট্রেনের ধাক্কায় গুরুতর জখম হন। ঘটনার এক মাস পরেও কথা বলার শক্তি ফিরে পাননি তিনি। গত এক মাস ধরে ই এম বাইপাস লাগোয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। বিলের অঙ্ক ২৫ লক্ষ টাকা ছাড়িয়েছে। যে দুই তরুণীর প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে হচ্ছে তাঁকে, তাঁদের কোনও খোঁজ এখনও পাননি জীবনবাবুর আত্মীয়েরা।

কোনও রকমে পাঁচ লক্ষ টাকা জোগাড় করেছিলেন আত্মীয়েরা। সংবাদপত্রে এই দুর্ঘটনার খবর দেখে কয়েক জন এগিয়ে এসেছেন। স্থানীয় ক্লাব থেকে কুপন ছাপিয়ে কিছু টাকা সংগ্রহ হয়েছে। সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত তাঁদের সংগ্রহে ১১ লক্ষ টাকা। আরও তিন-চার লক্ষ টাকা জোগাড়ের আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে। বাকি টাকা  কী ভাবে জোগাড় হবে, তা ভেবে দিশাহারা জীবনবাবুর পরিজনেরা। সরকারি স্তরেও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।

নৈহাটির ৬ নম্বর বিজয়নগরের বাসিন্দা জীবনবাবু। বছর দশেক আগে স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাঁর। গত ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে শ্যামনগরে দিদির বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। বিকেলে বাড়ি ফিরবেন বলে ট্রেনের জন্য শ্যামনগর স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। সেই সময়ে হেডফোন কানে রেললাইন পেরোচ্ছিলেন দুই তরুণী। আপ লাইন দিয়ে ধনধান্য এক্সপ্রেস তখন স্টেশনে ঢুকছিল। কানে হেডফোন থাকায় শুনতে পাননি তরুণীরা।

ট্রেনটি ওই স্টেশনে থামে না। ফলে বেশ দ্রুত গতিতেই ঢুকছিল। অনেকে চিৎকার করলেও শুনতে পাননি দু'জন। ট্রেন যখন প্রায় তাঁদের ঘাড়ের উপরে এসে পড়েছে, তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁদের লাইন থেকে ঠেলে সরিয়ে দেন জীবনবাবু। তবে নিজে আর সরতে পারেননি। ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে জ্ঞান হারান তিনি। পরিজনেদের অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানে তেমন চিকিৎসা পাওয়া যায়নি। এর পরে অবস্থার কথা বিবেচনা করেই তাঁকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জীবনবাবুর ভাগ্নে সুজয় ঘোষ জানান, গত এক মাসে চারটি অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। চোয়ালের অস্ত্রোপচার এখনও বাকি। চিকিৎসায় সাড়া দিলেও কথা বলতে পারছেন না জীবনবাবু। একটি হাত এখনও অসাড়।

জীবনবাবুর আত্মীয়েরা জানিয়েছেন, ঘটনার পরপরই তাঁর পাড়ার ক্লাব কুপন ছাপিয়ে কয়েক লক্ষ টাকা তুলেছিল। নৈহাটি উৎসবের পক্ষ থেকে এক লক্ষ টাকা জীবনবাবুর চিকিৎসার জন্য দেওয়া হয়েছে। সংবাদপত্রের খবর পড়ে ব্যক্তিগত ভাবেও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছেন কয়েক জন। তবে প্রয়োজন তার চেয়েও অনেক বেশি।

আইটি কর্মী এক তরুণী জানালেন, তাঁরা কয়েক জন মিলে প্রায় ৩০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছেন জীবনবাবুর পরিবারের হাতে। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে প্রতি মাসে জীবনবাবুকে দু'হাজার টাকা করে দেবেন বলেও জানিয়েছেন। সুজয় বলছেন, ''আমরা সকলের কাছে যাচ্ছি। সরকারের কাছেও সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েছি। জানি না, বাকি টাকা কী করে জোগাড় করব। শুধু চাই, মামা যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন।''